সে মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। পা ফেলছে এলোমেলো ভাবে। প্রচুর মদ্যপানের পর মানুষ ঠিক এই ভঙ্গিতেই হাঁটে। আমি এত কঠিন না হলেও পারতাম না।
তিশ যখন খাবার নিয়ে এল তখন তাকে বললাম, তিশ, তুমি জীববিজ্ঞানী ইনোকে একটা কৰ্থা বলে আসতে পারবে।
তিশ উৎফুল্ল গলায় বলল, অবশ্যই পারব। কী কথা?
কবিতার তিনটি লাইন–রাত্রি কখনো সূর্যকে পায় না।/তাতে ক্ষতি নেই।/কারণ সে পেয়েছে অনন্ত নক্ষত্ৰবীথি।
তিশ অবাক হয়ে বলল, এর মানে তো কিছু বুঝতে পারছি না। সূর্য যা, নক্ষত্রও তো তাই। নাম ভিন্ন কিন্তু জিনিস তো একই।
তোমার বোঝার দরকার নেই। ইনোকে বললেই তিনি বুঝবেন।
আর যদি বুঝতে না পারে? যদি আমাকে বুঝিয়ে দিতে বলে, তা হলে তো মুশকিলে পড়ব।
তোমাকে যা করতে বলছি তাই কর।
বেশ, করব। আমাকে শুধু একটা কথা বল–এটা কি কোনো প্রেমবিষয়ক কবিতা?
জানি না।
ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। প্রেম বিষয়ক কবিতা বলেই তো মনে হচ্ছে।
তিশকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি সে অত্যন্ত আগ্ৰহ বোধ করছে। যন্ত্র মানুষের মতো আগ্রহ বোধ করছে, খুবই অবাক হবার মতো ব্যাপার। আর আমি মানুষ হয়ে যন্ত্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছি। গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, তিশ শুনে যাও।
তিশ থমকে দাঁড়াল। আমি বললাম, ইনোর কাছে তোমাকে যেতে হবে না।
কেন?
প্রশ্ন করবে না। তোমাকে যেতে নিষেধ করছি, তুমি যাবে না।
তিন লাইনের কবিতাটা তাকে শোনাব না?
আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বাতি নিভিয়ে দিলাম। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার নয়। হালকা আলো আছে। এই রকম আলোয় মন বিষন্ন হয়। হাজার হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা একটি গ্রহের কথা মনে হয়। সেই গ্রহের এক জন মানবীর কথা মনে পড়ে, যার সঙ্গে এই জীবনে আর দেখা হবে না।
হাত বাড়িয়ে মাথার বাঁ পাশের নীলঙ্কটা সুইচ টিপলাম। হালকা সংগীত বাজতে শুরু করল। মাঝে মাঝে এই সংগীত আমি শুনি। এর জন্ম পৃথিবীতে নয়। অজানা এক গ্ৰহে অজানা গ্রহের অচেনা উন্নত কোনো প্রাণী এই সুর সৃষ্টি করেছে। গভীর বিষাদময় সুর।
প্ৰচণ্ড অস্বস্তির মধ্যে
প্ৰচণ্ড অস্বস্তির মধ্যে জেগে উঠলাম। কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি? মনে করতে পারছি না। হয়তো দেখেছি। দুঃস্বপ্ন প্রায় সময়ই মনে থাকে না, কিন্তু তার প্রভাব মানুষকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ৩৩৬.৭২৫২, এই ঘড়ি আমার কাছে এখনো অর্থহীন। শুধু জানি এই ঘড়ি মহাকাশযানের সময় বলছে। ৩৩৬.৭২৫২ ঘণ্টা আগে মহাকাশযান যাত্রা শুরু করেছে। যাত্রা শুরুর সময় ছিল শূন্য ঘণ্টা। এখানে আরো দুটি ঘড়ি আছে। একটিতে দেখান হচ্ছে পৃথিবীর সময়। সেখানে সময় প্রসারণ বা ডাইলেশনের ব্যাপারগুলি হিসাবের মধ্যে ধরা আছে। আমি সেই হিসাব বুঝি না। অবশ্যি বোঝবার চেষ্টাও করি না। কারণ ঘড়ির সময় বোঝা বা বোঝার চেষ্টা করা এখানে অর্থহীন। যেই মুহূর্তে হাইপার স্পেস ডাইভ দেয়া হবে সেই মুহূর্তেই সময় অদ্ভুতভাবে জট পাকিয়ে যাবে। সেই জটের অর্থ উদ্ধার করা মানুষের পক্ষে এখনো সম্ভব হয় নি।
আমি বিছানা ছেড়ে নামলাম। তৃষ্ণা পেয়েছিল কয়েক ঢোক পানি খেলাম। অস্বস্তিটা কমল না, বরং বেড়ে যেতে লাগল। যেন বিরাট কিছু হতে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর কিছু। নিজেকে একটু হালকা হালকাও লাগছে। কৃত্রিম উপায়ে মহাকাশযানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তৈরি করা হয়। এখানে ওজন শূন্যতা নেই। কিন্তু নিজেকে হালকা লাগছে কেন? আমি সুইচ টিপে তিশকে ডাকলাম। উদ্বিগ্ন গলায় বললাম, কিছু হয়েছে নাকি তিশ।
তিশ বলল, কী হবে?
আমার কী কারণে যেন খুব অস্বস্তি লাগছে।
এরকম সবারই মাঝে মাঝে লাগে। একে বলে গতিজনিত শারীরিক বিপর্যয়। আমাদের গতিবেগ এখন ৩,৪৩C, অর্থাৎ আলোর গতিবেগের প্রায় তেতাল্লিশ শতাংশ। গতিবেগ যখন ০-৬০ হবে বা তার চেয়ে বেশি হবে তখন শারীরিক বিপর্যয় শুরু হবে। হট বিট দ্রুত কমতে থাকবে, ব্লাড প্ৰেশার কমবে, বিপাক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে এবং গায়ের তাপমাত্রা প্রায় সাত ডিগ্রীর মতো কমে যাবে। ভয়ের কিছু নেই, ওষুধপত্রের ভালো ব্যবস্থা আছে। আমি কি তোমাৱজন্যে ডাক্তার রোবটকে খবর দেব?
না।
আমাদের এই ডাক্তার রোবট মনোবিশ্লেষণের ব্যাপারেও এক জন বিশেষজ্ঞ। আমার মনে হয় তোমার উচিত তার সঙ্গে কথা বলা।
তুমি বিদেয় হও। তিশকে বিদেয় দিয়ে আমার অস্বস্তি আরো দ্রুত বাড়তে লাগল। যতই সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে। এই প্রথম বার মনে হল আমরা একটা চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে এগুচ্ছি। কোনো এক আকৰ্ষণী শক্তির মধ্যে পড়ে গেছি–যার শক্তি অকল্পনীয়। আমার মনে হল মহাকাশযানের প্রতিটি পরমাণুর ওপর এই শক্তির অশুভ ছায়া পড়েছে। এই শক্তি যেন নিয়তির মতো অমোঘ। এর হাত এড়াবার কোনো উপায় নেই। অথচ মহাকাশযানের সব কিছুই খুব স্বাভাবিকভাবে চলছে বলে মনে হচ্ছে। আমার মাথার ওপর বিন্দুর মতো একটি আলো জ্বলছে, যার মানে মহাকাশযানে কোন যান্ত্রিক ক্ৰটি নেই। প্রতিটি যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে। তা তো হতে পারে না।
আমি নিজের ঘর ছেড়ে বেরুম। হলঘরে মিনিট খানেক কিংবা তার চেয়েও কিছু কম সময় দাঁড়িয়ে ভাবলাম কী করা উচিত। একবার মনে হল। আমার কিছুই করার নেই, যা হবার হোক। আমি বরং আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি। এই ভাবনা দীর্ঘস্থায়ী হল না। আমি রওনা হলাম জন বরগের ঘরের দিকে। আগে থেকে যোগাযোগ না করে তাঁর ঘরে যাবার নিয়ম নেই, কিন্তু ততটা সময় মনে হচ্ছে আমার হাতে নেই।