যে জীববিজ্ঞানীর কথা বলছি তার বয়স কম এবং সে এক জন অত্যন্ত রূপবতী তরুণী।
তাতে কি?
হাসিখুশি ধরনের মেয়ে। সবাই তাকে পছন্দ করে।
খুবই ভালো কথা।
এই তরুণীর গলার স্বর খুব মিষ্টি। শুধু শুনতে ইচ্ছা করে।
বেশ তো, শুনতে ইচ্ছা করলে শুনবে।
আমি প্রায়ই শুনি। রোবট হওয়া সত্ত্বেও আমি এই মেয়েটির প্রতি এক ধরনের আবেগ অনুভব করি।
অত্যন্ত আনন্দের কথা।
এই তরুণীর নাম ইনো। নামটিও কি মধুর নয়?
খুবই মধুর। এখন তুমি বিদেয় হও।
বিদেয় হচ্ছি। আমি ক্ষুদ্র একটা অন্যায় করেছি, এটা বলেই বিদায় নেব। অন্যায়টা হচ্ছে আমি ইনোকে বলেছি যে তুমি তার সঙ্গে কথা বলবার জন্যে বেশ আগ্রহী। সাহস সঞ্চয় করতে পারছ না বলে কথা বলতে পারছ না।
এ রকম বলার মানে কী?
যোগাযোগ করিয়ে দেয়া। মেয়েটা খুবই ভালো। কথা বললে তোমার চমৎকার লাগবে। ও আবার চমৎকার হাসির গল্পও জানে।
তুমি বিদেয় হও।
হচ্ছি। আমার সঙ্গে এত উঁচু গলায় কথা বলার কিন্তু কোনো দরকার নেই। একজন রোবটের সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলাও যা, নিচু গলায় কথা বলাও তা। আমি তো আর তোমাদের মতো মানুষ না যে উঁচু গলায় কথা বললে আমার মন খারাপ হবে।
প্ৰচণ্ড ধমক দিয়ে তিশকে বিদায় করলাম। এবং বলে দিলাম এক্ষুণি যেন ইনো নামের মেয়েটিকে সত্যি কথাটা বলে। পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী তরুণীর সঙ্গেও আমি কথা বলতে আগ্রহী নই।
তিশ আমার সব কথা শশানে না। অনেক কাজ সে তার নিজের লজিক খাটিয়ে করে। কাজেই সে ইনোকে কিছুই বলল না। এবং ইনো নামের অত্যন্ত রূপবতী বালিকা বালিকা চেহারার মেয়েটি এক সময় আমার ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে বলল, আসব?
এই জাতীয় একটি মেয়ের মুখের ওপর না বলা খুব মুশকিল। আমি হা-না কিছুই বললাম না।
তিশ আমাকে বলল, আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। সাহসের অভাবে বলতে পারছেন না।
তিশ সত্যি কথা বলে নি। বানিয়ে বানিয়ে বলেছে। আপনার সঙ্গেই শুধু নয়, কারো সঙ্গেই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
কেন করে না?
জানি না কেন। মানুষের সঙ্গ আমার কাছে অসহ্য বলে মনে হয়।
আমার সঙ্গও অসহ্য বোধ হচ্ছে?
হ্যাঁ, হচ্ছে।
সত্যি বলছেন?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আপনিলে গেলেই আমি খুশি হব।
মেয়েটি চলে গেল না। ঘরে ঢুকল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আপনি আমাকে তাড়াবার জন্য এইসব বলছেন। কিন্তু আমি এত সহজে যাচ্ছি না। আমার বয়স একত্রিশ। গত পঁচিশ বছরের কথা আমার মনে আছে। এই পঁচিশ বছরে কেউ আমাকে বলে নি যে আমার সঙ্গ তার পছন্দ নয়। যদিও আমি অনেকের সঙ্গ পছন্দ করি না। তবে পছন্দ না করলেও কাউকে মুখের ওপর সে কথা বলতে পারি না। এত সাহস আমার নেই। আমি বোধ হয় একটু বেশি কথা বলছি, তাই না?
হ্যাঁ। তাই।
বিশ্বাস করুন আমি এত কথা বলি না। কিন্তু মহাকাশযানে উঠবার পর থেকে কেন জানি ক্ৰমাগত কথা বলছি। এটা বোধ হয়, হচ্ছে ভয় পাওয়ার কারণে। ভীত মানুষ দুধরনের কাণ্ড করে হয় আমার মতো বেশি কথা বলে, নয় আপনার মতো কথা বলা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। আপনিও নিশ্চয়ই আমার মতো, তাই না?
না।
বলেন কী! হাইপার স্পেস ডাইভ দিতে যাচ্ছেন, এটা ভেবেও কি আপনার ভয় বা রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছে না?
না, আমি কিছু ভাবি না।
সে কি! কেন?
ভাবতে ইচ্ছা করে না।
ইএসপি ক্ষমতাধর সব মানুষই কি আপনার মতো হয়?
তাও আমি জানি না। এরকম কারো সঙ্গে আমার এখনো দেখা হয় নি।
ইনো খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, এখানে আসার পেছনে আমার অন্য একটা উদ্দেশ্যও আছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে উদ্দেশ্যটা বলব।
ইনো আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তরল চোখ। কিছু কিছু চোখ আছে তাকালে মনে হয় জলভরা চোখ। যেন চোখের ভেতরের টলটল জল দেখা যাচ্ছে।
আমি কিছুই বললাম না। ইনো বলক, আমি এসেছি আপনার ইএসপি ক্ষমতা কী রকম তা পরীক্ষা করে দেখতে।
আমার কোনো ক্ষমতা নেই।
আপনি অস্বীকার করলে তো হবে না। আমাদের বলা হয়েছে আপনার ক্ষমতা অসাধারণ। প্রতিটি জেনার টেস্টে আপনি এক শ করে পেয়েছেন। কেউ তা পায় না।
জেনার টেস্টের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
বেশ, না জানলে ক্ষতি নেই। এখন মন দিয়ে শুনুন আমি কি বলছি। আমার জ্যাকেটের পকেটে এক খণ্ড কাগজে আমি তিন লাইনের একটা কবিতা লিখে এনেছি। কী লিখেছি আপনি কি বলতে পারবেন?
কাগজটা না দেখে কী করে বলব? কী লেখা আছে তা জানতে হলে লেখাগুলি আমাকে পড়তে হবে।
লেখা পড়ে তো যে কেউ বলতে পারবে। তাহলে আপনার বিশেষত্ব কোথায়?
বিশেষত্ব কিছুই নেই। এখন আপনি যদি দয়া করে উঠে যান এবং আমাকে একা থাকতে দেন তাহলে খুব খুশি হব।
ইনো উঠে দাঁড়াল। অপমানে মেয়েটির মুখ কালো হয়ে গেছে। তার অপমানিত মুখ দেখতে আমার একটু যেন খারাপই লাগছে। সে আমাকে কী একটা বলতে গিয়েও বলল না। মুখ নামিয়ে নিল। আর ঠিক তখন বিদ্যুৎ চমকের মতো তার জ্যাকেটের পকেটে রাখা কাগজটির লেখাগুলি আমি পড়তে পারলাম। ব্যাপারটা কী করে হল আমি নিজেও জানি না। প্রতিটি লাইন জ্বলজ্বল করছে।
রাত্রি কখনো সূর্যকে পায় না।
তাতে ক্ষতি নেই।
কারণ সে পেয়েছে অনন্ত নক্ষত্রবীথি।
এক বার ইচ্ছা হল, কাগজটায় কী লেখা ইনোকে বলি। তারপরই ভাবলাম কী দরকার? কী হবে বলে?
ইনো নরম গলায় বলল, আপনি যে সত্যি সত্যি বিরক্ত হচ্ছিলেন তা বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলে আমি এতক্ষণ বসে থাকতাম না। আমি খুবই লজ্জিত, আমাকে ক্ষমা করবেন।