আমাকে এসব আকর্ষণ করে না। আমার মনে হয় আমি তো ভালোই আছি। সুখেই আছি, খুব যখন নিঃসঙ্গ বোধ হয় তখন তিশ-২-এর সঙ্গে কথা বলি। খুবই সাধারণ কথাবার্তা। যেমন এক দিন বললাম, কেমন আছ তিশ?
কোন অর্থে জিজ্ঞেস করছ? যান্ত্রিক অর্থে আমি ভালো আছি।
যান্ত্রিক অর্থ ছাড়া অন্য কোনো অর্থ আছে কি?
নিশ্চয়ই আছে। আবেগ অৰ্থেও এই প্রশ্ন করা যায়। আমি রিবো-ত্রি সার্কিটসম্পন্ন রোবট, আমার কিছু পরিমাণ আবেগ আছেযদিও তা মানুষের মতো তীব্র নয়।
আবেগ অৰ্থে তুমি কেমন আছ?
আবেগ অর্থে খুব ভালো নেই।
কেন?
অন্য একটি গ্যালাক্সিতে যাচ্ছি, এটা চিন্তা করেই বেশ কাহিল বোধ করছি। কে জানে কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে।
অবিকল মানুষের মতো কথা। যন্ত্রের মুখে মানুষের মতো কথা শুনতে ভালো লাগে না। যন্ত্র কথা বলবে যন্ত্রের মতো। মানুষ কথা বলবে মানুষের মতো। তিশ-২-এর সঙ্গে আমার কথাবার্তা এই কারণেই বেশি দূর এগোয় না। খানিকক্ষণ কথা বলার পরই আমি হাই তুলে বলি, ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পার।
তিশ-২-এর স্বভাব-চরিত্রও অনেকটা মানুষের মতো। তুমি যেতে পার বলার পরও সে যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে চুপ কর বললে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার কথা শুরু করার চেষ্ট্রা করে। খুবই যন্ত্রণার ব্যাপার। আমি যা জানতে চাই না তাও সে আমাকে বলতে থাকে। যেমন এই মহাকাশযান কী জ্বালানি ব্যবহারে তা জানার আমার কোনো রকম আগ্রহ নেই, কিন্তু সে ঘ্যানঘ্যান করে বলবেই।
এই রোবটের কারণে, আগ্রহ নেই এমন সব বিষয়ও আমাকে জানতে হচ্ছে। আমি এখন জানি এই মহাকাশযান চার স্তরবিশিষ্ট। প্রথম স্তর হচ্ছে জ্বালানি স্তর। একটি থ্রাস্টার এবং একটি কনভার্টার (যা হিলিয়াম অণুকে হিলিয়াম আয়নে পরিণত করে) ছাড়াও আছে অসম্ভব শক্তিশালী চারটি ম্যাগনেটিক ফিল্ড জেনারেটর। একটি যেটন এমিটার, যাদের প্রয়োজন পড়ে শুধুমাত্র হাইপার স্পেস ডাইভের সময়। দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেইনটেনেন্স বিভাগ। তৃতীয় স্তরে ক্ৰদের থাকবার ব্যবস্থা, খেলাধুলো এবং আমোদ প্রমোদের স্থান। চতুর্থ স্তরে আছে ল্যাবোরেটরি এবং অবজারভেশন প্যানেল। কমুনিকেশন বা যোগাযোগের যাবতীয় যন্ত্রপাতিও আছে এই স্তরে। কোনো নতুন গ্রহে অনুসন্ধানী স্কাউটশিপও এই চতুর্থ স্তর থেকেই পাঠান হয়। মহাকাশযানের মস্তিষ্ক হচ্ছে কম্পিউটার। তাও চতুর্থ স্তরে। হাইপার স্পেস ডাইভ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিটি মহাকাশযানেই সিডিসি-১০ জাতীয় কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। এই কম্পিউটারগুলির কার্যপদ্ধতি মানুষ এখনো পুরোপুরি জানে না। কারণ এই কম্পিউটারের উদ্ভাবক মানুষ নয়। হাইপার স্পেস ডাইভ এবং সিডিসি-১০ কম্পিউটার দুটিই মানুষ পেয়েছে মিডিওয়ে গ্যালাক্সির সিরান নক্ষত্রপুঞ্জের মহাবুদ্ধিমান প্রাণী ইয়েসীদের কাছ থেকে। মাকড়সা শ্রেণীর এইসব প্রাণীরা তাদের উচ্চতর প্রযুক্তির বিনিময়ে পৃথিবী থেকে নিয়ে যায় অতি সাধারণ কিছু উদ্ভিদ। তারা এই সব উদ্ভিদ দিয়ে কী করে, কেনইবা তারা অতি সাধারণ কিছু উদ্ভিদের জন্যে এত মূল্য দিতে প্রস্তুত, সেই সম্পর্কে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা কিছুই জানেন না।
কারণ ইয়েসীরা এই বাণিজ্য সরাসরি করে না, করে কিছু রোবটের মাধ্যমে। এই সব রোবট কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না।
তাদের অনেক বার বলা হয়েছে, এই সামান্য লতা জাতীয় গাছগুলি দিয়ে তোমরা কী করবে?
রোবটরা উত্তর দিয়েছে, আমরা কী করব সেটা আমাদের ব্যাপার। হাইপার স্পেস ডাইভ সংক্রান্ত টেকনলজির বিনিময়ে তোমরা যদি উদ্ভিদ দাও দেবে, যদি না দিতে চাও দেবে না। এর বাইরের যাবতীয় কথাবার্তাই আমরা বাহুল্য মনে করি। এবং আমরা বাণিজ্য-সম্পর্কহীন প্রশ্নের কোনো জবাব দেব না।
এইসব খবরের সবই আমি ধেয়েছি তিশ-২ রোবটের কাছ থেকে। সে ক্ৰমাগতই কিছু না কিছু তথ্র আঁমাকে দিতে চেষ্টা করছে। এবং আমার ধারণা এটা সে করছে মহাকাশের ব্যাপারে আমার আগ্রহ বাড়ানোর জন্যে।
সে আমার ভেতর কৌতূহল জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছে। কৌতুহল হচ্ছে জীবনদায়িনী শক্তির মতো, যা আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। আমার মধ্যে কৌতূহলের কিছুই অবশিষ্ট নেই। জীবন আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এক জন রোবটের সঙ্গে আমি আমার কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না। এই অবস্থাতেই মানুষ আত্মহননের কথা চিন্তা করে। আমিও করছিলাম।
তিশ তা বুঝতে পেরেছে। সে এই কারণেই প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে আমার মধ্যে কৌতূহল নামক সেই জীবনদায়িনী ব্যাপারটি জাগিয়ে তুলতে। তার কিছু কিছু চেষ্টা আমার খুব ছেলেমানুষি বলে মনে হয়। যদিও জানি ছেলেমানুষি কোনো ব্যাপার তিশ-২-এর মতো উন্নত রোবট কখনো করবে না। তিশ যা করছে খুব ভেবেচিন্তেই করছে। সে ব্যবহার করছে। রোবটদের লজিক, আবেগবৰ্জিত বিশুদ্ধ লজিক। এর ভেতর কোনো ফাঁকি নেই। এক দিন—এই যা, দিন শব্দটা ব্যবহার করলাম। দিন এবং রাত বলে মহাকাশযানে কিছু নেই। এখানে যা আছে তার নাম অনন্ত সময়। যে কথা বলছিলাম, এক দিন তিশ এসে বলল, মহাকাশযানে এক জন জীব বিজ্ঞানী আছে তা কি তুমি জান?
আমি বললাম, জানি।
তুমি তার সঙ্গে আলাপ কর না কেন? তার সঙ্গে কথা বললে তোমার খুব ভালো লাগবে।
কারো সঙ্গেই কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।