জন্মসূত্রে আপনি যে ক্ষমতা নিয়ে এসেছেন তার কথা তো আপনার জানার কথা নয়। তা জানবে অন্য জন। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, আপনি টিভি প্রোগ্রাম মনিটর করতেন।
হ্যাঁ, ওটাই আমার চাকরি।
চ্যানেল থিীর একটা প্রোগ্রাম আপনি মনিটর করছিলেন, তাই না?
হ্যাঁ।
যে সময় ঐ প্রোগ্রামটি চলত তখন মাত্র নয় দশমিক একভাগ লোক ঐ প্রোগ্রাম দেখত। চল্লিশ দশমিক দুই ভাগ লোক কোনো প্রোগ্রামই দেখত না। বাকিরা দেখত অন্য চ্যানেলের প্রোগ্রাম, ঠিক না?
হ্যাঁ, ঠিক।
অথচ আপনি যাদের বাসায় টেলিফোন করতেন তারা সবাই ঐ প্রোগ্রামটি দেখত। আপনি জেনেশুনে টেলিফোন করতেন না। এমনিতেই করতেন। কিন্তু দেখা যেত ঐ বাসায় কেউ না কেউ চ্যানেল থ্রির প্রোগ্রামটি দেখছে। খুব উঁচু ধরনের ইএসপি ক্ষমতা না থাকলে তা সম্ভব নয়। তাছাড়া–।
তাছাড়া কী?
আপনাকে নিয়ে পাঁচটি জেনার টেস্ট করা হয়েছে। প্রতিটি টেস্টে আপনি এক শ নম্বর স্কোর করেছেন, যা অকল্পনীয় একটা ব্যাপার।
আমার ইএসপি ক্ষমতা কী কাজে লাগবে?
হয়তো কোনোই কাজে লাগবে না, তবে মহাকাশ-যাত্রা, বিশেষ করে নিজেদের গ্যালাক্সি ছেড়ে অন্য একটি গ্যালাক্সিতে পা দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপারে আপনার মতো ইএসপি ক্ষমতাধর কাউকে দরকার।
আমার ইচ্ছা করছিল আচমকা লোকটির গালে একটা চড় বসিয়ে দিই। বহু কষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করলাম। কী লাভ? কী হবে হৈচৈ করে? কিছুই হবে না। যথাসময়ে আমাকে যাত্রা করতে হবে। যেতে হবে সব কিছু পেছনে ফেলে। এই পৃথিবীকে আমার কখনো অসাধারণ কিছু বলে মনে হয় নি, তবু পৃথিবীর জন্যে মায়া লাগছে।
বরগ মিশন
আমাদের এই মিশনটির একটি নাম আছে–বরগ মিশন। মহাকাশযানের অধিনায়ক জন বরগের নাম অনুসারে মিশনের নাম।
আমি ভেবেছিলাম জন বরগ লোকটি অসাধারণ কেউ হবেন। হয়তো তিনি অসাধারণ। কিন্তু আমার কাছে প্রথম দর্শনে তাঁকে খুব অসাধারণ মনে হল না। রোগা লম্বা একজন মানুষ। বেশিক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না কিংবা কথা বলেন না। চোখ নামিয়ে নেন। মেয়েদের মতো পাতলা ঠোঁট। ঠোঁট টিপে হাসার অভ্যাস আছে। খুব জরুরি ধরনের কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ তার দিকে তাকালে দেখা যাবে তিনি মাথা নিচু করে ঠোঁট টিপে হাসছেন। যেন কথাবার্তা কিছু শুনছেন না, অন্য কিছু ভাবছেন।
সাত জন ক্রু মেম্বারদের মধ্যে অধিনায়ক জন বরগকেই আমার কাছে মনে হল সবচেয়ে সাধারণ। প্রথম দর্শনে মানুষের ওপর প্রভাব ফেলার কোনো ক্ষমতা এই মানুষটির নেই।
তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হবার কথা বলি। মহাকাশযান পৃথিবীর মহাকর্ষণ অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। শেষ বারের মতো পৃথিবী দেখার জন্যে সবাই ভিড় করেছে অবজারভেশন প্যানেলে। আমি শুধু নেই। ফেলে আসা পৃথিবীর জন্যে আমি কোনো রকম আকর্ষণ বোধ করছি না। নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছি। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল। আমি বললাম, কে? নরম গলায় উত্তর এল, আমার নাম জন বরগ।
আমি দরজা খুললাম। জন বরগ হাসিমুখে বললেন, সবাই শেষ বারের মতো পৃথিবী দেখছে। আপনি দেখছেন না?
ইচ্ছা করছে না।
চমৎকার! আমারো ইচ্ছা করছে না। এবং আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? আমার মনে হচ্ছে আমরা আবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসব।
আমার এরকম কিছু মনে হচ্ছে না।
আপনার কী রকম মনে হচ্ছে?
কোনো রকমই মনে হচ্ছে না।
জন বরগ হাসিমুখে বললেন, আপনার কথা শুনে ভরসা পাচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম বলে বসবেন, আমরা আর পৃথিবীতে ফিরে আসব না।
আমি এ রকম বললে অসুবিধা কী?
আপনি হচ্ছেন একজন ইএসপি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আপনি না সূচক কিছু বললে একটু খটকা তো লাগবেই, তবে–
আমি জন বরগের দিকে তাকালাম। তিনি নিচু অথচ স্পষ্ট স্বরে বললেন, ইএসপি ক্ষমতামতা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। যে জিনিস আমি বুঝতে পারি না, সে জিনিসের প্রতি আমার আগ্রহ নেই। কাজেই আপনার এই ক্ষমতা আমি কখনো ব্যবহার করব না। আপনি হয়তো জানেন না মহাকাশযানের অধিনায়ক হচ্ছেন দ্বিতীয় ঈশ্বর। সব কিছুই চলে তাঁর হুকুমে।
আমি সহজ গলায় বললাম, মহাকাশযানের অধিনায়ক যদি দ্বিতীয় ঈশ্বর হন, তাহলে প্রথম ঈশ্বর কে?
প্রথম ঈশ্বর বলে কেউ নেই। ওটা হচ্ছে কথার কথা।
এই বলেই জন বরগ মৃদু হাসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে আবার ঠোঁট টিপে মৃদু গলায় বললেন, যাই, কেমন?
আমি কিছু বললাম না। জন বরগ লোকটিকে যতটা সাধারণ মনে হয়েছিল, ততটা সাধারণ সে নয়। আমার ঘরে তার আসার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল আমাকে জানিয়ে দেয়া যে, সে আমার ক্ষমতার ধার ধারে না। এটা সে জানিয়েছে চমৎকার ভঙ্গিতে।
বরগ মিশনের বাকি দুজন কর্মীর সঙ্গে প্রথম বাহাত্তর ঘন্টায় আমার কোনো রকম কথাবার্তা হল না। আমি নিজের ঘর থেকে বেরুলাম না। বেরুবার মতো তেমন কোনো কারণও ঘটল না। খাবার আসে ঘরে। তিশ-২ নামের একজন রোবট খাবার দিয়ে যায়, নিয়ে যায়।
আমি প্রায় সারাক্ষণই শুয়ে থাকি। মহাকাশযানের উড়ে চলার ধাতব শব্দ শুনি। লক্ষ কোটি ঝিঝি পোকার শব্দ ব্রঙস শব্দ বাড়ে এবং কমে। আমি কিছুই করি না। শুয়ে থাকি।
আমাকে বলা হয়েছে এই মহাকাশযানে সময় কাটানোর চমৎকার সব ব্যবস্থা আছে। এদের লাইব্রেরি পৃথিবীর যে কোনো বড় লাইব্রেরির মতোই। দুর্লভ সব সংগ্রহ এখানে আছে। ভিডিও সংগ্রহশালাটিও নাকি অসাধারণ। বিশেষ করে মানুষের মহাকাশ-যাত্রার ইতিহাস বিভাগ। প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে ফিল্মও এখানে আছে। প্রজেকশন রুমে বসলেই হল। এখানে আছে সব রকম খেলাধুলার ব্যবস্থা। এমনকি সাঁতারের জন্যে ছোট একটি সুইমিংপুলের মতও নাকি আছে, যার পানিতে ইলেকট্ৰিকেল চার্জ থাকায় সাঁতারের ব্যাপারটি হয় স্বৰ্গীয় আনন্দের মতো। আয়নিত জলকণা শরীরে ধাক্কা দেয়। প্রচণ্ড শারীরিক সুখের একটা অনুভূতি হয়।