ফিরে আসব কবে?
কখন ফিরবেন এই ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। একটি হাইপার স্পেস ডাইভের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বয়স প্রায় এক শ বছর বেড়ে যায়। ধরুন, তিনটি হাইপার স্পেস ডাইভ দিয়ে আপনি পৃথিবীতে ফিরলেন। ফিরে এসে দেখবেন পৃথিবীর বয়স তিন শ বছর বেড়ে গেছে। হয়তো পৃথিবী কোনো প্রাকৃতিক কারণে ধ্বংসই হয়ে গেছে। কাজেই ফিরে আসার সময় জানতে চাওয়া অর্থহীন।
আমি অবাক হয়ে এই লোকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী বলছে সে! এর মানে কী!
কত বড় সৌভাগ্য আপনার ভেবে দেখুন। আপনি হবেন মানবজাতির প্রথম প্রতিনিধি দলের একজন, যে অন্য একটি গ্যলাক্সিতে পা রাখবে।
কী হবে পা রেখে?
অনেক কিছুই হতে পার। হয়তো অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো প্রাণীর সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ হবে। তাদের কল্যাণে আমরা সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্যগুলি জেনে ফেলতে পারব। সময় ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারছি না। তারা হয়তো আমাদের সময় ব্যাপারটা কী, বুঝিয়ে দেবে। আমরা তখন ইচ্ছামতো সময়কে সংকুচিত ও প্রসারিত করতে পারব।
আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি আর কোনোদিন এই চেনা পৃথিবীতে ফিরে আসব না?
হ্যাঁ তাই।
আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে এই ঘর থেকে বের করে আলাদা করে ফেলা হল। আমি কত জনকে যে বললাম, আমাকে একটা টেলিফোন করতে দিন। এক জনের সঙ্গে একটু কথা বলব। ঘড়ি ধরে এক মিনিট। এর বেশি নয়।
কেউ আমার কথার কোনো উত্তর দিল না। এক জন শুধু বলল, সপ্তম কেন্দ্রের গবেষণাগার থেকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই।
নিকির সঙ্গে আমার কথা বলা হল না।
সময়ের কোনো হিসাব আমার কাছে ছিল না। গবেষণা কেন্দ্রের যেখানে আমাকে রাখা হল, দিন এবং রাত বলে সেখানে কিছু নেই। সারাক্ষণই কৃত্রিম আলো জ্বলছে। আমাকে বলা হল মানুষের শরীরে দিন। রাত্রির যে চক্র তৈরি হয় তা ভেঙে দেবার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাদের কোনো কথাই আমি মন দিয়ে শুনি না। যা করতে বলে করি, এই পর্যন্তই।
এক বার তারা আমাকে একটা সিলিন্ডারের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। এ জাতীয় অন্ধকার পৃথিবীতে কখনো পাওয়া যায় না। অন্ধকার যে এত ভয়াবহ হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। কত সময় যে কেটে গেল সেই সিলিন্ডারে। কী ভয়াবহ অবস্থা! প্ৰচণ্ড খিদে, তবু মনে হয়েছে খাদ্য নয়, আমার প্রয়োজন আলে। সামান্য আলো। প্ৰদীপের একটি ক্ষুদ্র শিখার জন্যে আমি আমার নশ্বর জীবন দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আলো ভাগ্যে জোটে নি। খাদ্য এসেছে, আলো নয়। আশ্চর্য, এক সময় সেই অন্ধকারও সহ্য হয়ে গেল। মনে হল আলোহী এই জগতইব। মন্দ কি। যখন পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম তখন আমাকে চোখ-ধাঁধানো আলোয় ঝলমল করছে এমন একটি ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। আহ্ কী তীব্র আলো! প্ৰাণপণে চেঁচিয়েছি, আলো চাই না, অন্ধকার চাই। কুৎসিত এই আলোর হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর।
কত বিচিত্র ধরনের ট্রেনিং। ভরশূন্যতার ট্রেনিং, শব্দহীন জগতের ট্রেনিং আবার ভয়াবহ শব্দের ট্রেনিং।
তারপর একদিন ট্রেনিং পর্ব শেষ হল। আমাকে গোলাকার একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আমার সঙ্গে গবেষণাগারের এক জন কর্মী। ঘরটির মাঝখানে ছোট্ট টেবিলে একটা টেলিফোনের সেট।
গবেষণাগারের কর্মী আমাকে বললন, এখন আপনি আপনার বান্ধবীকে একটা টেলিফোন করতে পারেন। নাম্বার মনে আছে তো, নাকি ট্রেনিং-এর ঝামেলায় সব ভুলে বসে আছেন?
নাম্বার মনে আছে।
নিকিকে তার বাসার নাম্বারেই পাওয়া গেল। সে অসম্ভব অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার তোমার?
আমি বহু কষ্ঠে বললাম, তোমার কী খবর? তুমি কেমন আছ? নিকি রাগী স্বরে বলল, আমার খবর তোমার কী দরকার? তুমি তোমার খবর বল। হচ্ছেটা কী?
আমাকে একটা মহাকাশযান করে পাঠান হচ্ছে।
কী বলছ তুমি এসব!
সত্যি কথাই বলছি নিকি।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমিও বুঝতে পারছি না।
প্রায় দশ মিনিটের মতো কথা বললাম। নিকি ব্যাকুল হয়ে কাঁদল। আমার চোখও বারবার ভিজে উঠল। এক সময় টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। আমার সঙ্গী আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার চোখে চোখ রেখে একটু হেসে বললাম, এতক্ষণ যার সঙ্গে কথা বললাম, সে নিকি নয়। সে আপনাদের একজন।
আমার সঙ্গী বিস্মিত হয়ে বলল, একথা কেন বলছেন? তার গলার স্বর কি আপনার কাছে অন্য রকম মনে হয়েছে?
না, গলার স্বর নিকির মতো। আচার-আচরণ, কথা বলার ঢং সবই নিকির মতো। তবু আমি জানি, সে নিকি নয়।
কখন জানলেন?
টেলিফোন নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে জানলাম।
আপনি ঠিকই ধরেছেন। এতক্ষণ আপনি কথা বলেছেন একটি ভয়েস সিনথেসাইজারের সঙ্গে।
আমার সঙ্গে এই রসিকতা করার প্রয়োজনটা তো ধরতে পারছি না। শুরুতে আমি নিকির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছি। পরে কিন্তু আর চাই নি।
আমরা ছোট্ট একটা পরীক্ষা চালানর জন্যে টেলিফোনের ব্যবস্থাটা করেছি।
কী পরীক্ষা?
মহাকাশযানে করে পাঠানর জন্যে সব সময় স্বাভাবিক ক্ৰদের বাইরে এক জনকে নেয়া হয়। সেই একজন কিন্তু রাম শ্যাম যদু মধু কেউ নয়। সেই একজন হচ্ছে বিশেষ একজন। যার কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে। ইএসপি জাতীয় ক্ষমতা। আপনার তা প্রচুর পরিমাণে আছে।
কী করে বুঝলেন?
সেন্ট্রাল কম্পিউটার পৃথিবীর সব মানুষদের সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখে। আপনার সম্পর্কে খবর সেখান থেকেই পাওয়া।
খবরটা ভুল। আমার ইএসপি কেন, কোনো ক্ষমতাই নেই। থাকলে আমি তা জানতাম। আমি জানব না, অথচ সেন্ট্রাল কম্পিউটার জানবেতা কী করে হয়?