সে কফির মগ নামিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি ভালো করেই জান আমি কে। অর্থহীন কথাবার্তা বলার প্রয়োজন দেখি না। ওরা তোমার দ্বিতীয় কপিটি তৈরি করেছে।
নকল কপি?
আসল-নকলের কোনো ব্যাপার নয়। ওরা যে জীন থেকে তোমাকে তৈরি করেছে, সেই একই জীন থেকে আমাকেও তৈরি করেছে। আসল হলে দুটোই আসল, নকল হলে দুটোই নকল।
ওরা কপি তৈরি করল কেন?
আমাকে এই প্রশ্ন করা কি অর্থহীন নয়? তোমার মনে যে প্রশ্ন আসছে, আমার মনেও সেই একই প্রশ্ন আসছে। শারীরিক এবং মানসিক এই দুই দিক দিয়েই তোমার সঙ্গে আমার কোনো প্ৰভেদ নেই। এই মুহূর্তেই তুমি কী ভাবছ তা আমি জানি, কারণ আমিও একই জিনিস ভাবছি।
কী ভাবছ? আমি ভাবছি নিকির কথা। নিকি কী করবে? কার কাছে যাবে? তোমার কাছে না আমার কাছে?
আমার গা ঝিমঝিম করতে লাগল। আসলেই আমি তাই ভাবছি। আমরা দুজন পাশাপাশি দাঁড়ান মাত্র নিকি সব গুলিয়ে ফেলবে। কার কাছে সে যাবে? আমার কাছে নাজার কাছে? তার কাছে যাওয়া মানেই তো আমার কাছে যাওয়া। কিন্তু সত্যি কি তাই? নিকি আমার সামনে ঐ লোকটিকে চুমু খাবে, এই দৃশ্য আমার পক্ষে সহ্য কার কি সম্ভব? না, সম্ভব নয়। আমি দ্বিতীয় বার বললাম, ওরা এমন করল কেন?
তুমি যা জান না, আমিও তা জানি না। তবে আমার মনে হয় নিকি আমাদের দুজনকে পেয়ে কী করে এবং আমরা কী করি, তাই তারা দেখতে চাচ্ছে। তোমারও নিশ্চয়ই সে রকমই মনে হচ্ছে, তাই না?
হ্যাঁ, তা-ই।
মানব-মানবীর সম্পর্কের ব্যাপারটায় তারা কৌতূহলী হয়েছে। এই জিনিসটা তারা পরীক্ষা করে দেখতে চায়। তোমারও নিশ্চয়ই সে রকমই মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ, হচ্ছে।
আমার তো মনে হয়, এদের সঙ্গে এখন আমাদের কথা বলা দরকার। ওরা কী চায় জানা দরকার। এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে ওদের সাহায্য ছাড়া উপায় নেই।
যোগাযোগটা করব কীভাবে? আমরা চেষ্টা করলে তো হবে না, এরা যখন যোগাযোগ করতে চাইবে তখনই হবে।
তা ঠিক। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ দেখছি না। অপেক্ষা করা যাক।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। ক্লান্তিকর দীর্ঘ প্রতীক্ষা। কোনো লাভ হল না। কেউ যোগাযোগ করল না। আমরা তিন জন অপেক্ষা করছি। তিন জন বলা কি ঠিক হচ্ছে? না, ঠিক হচ্ছে না। আমরা আসলে দুজন। আমি এবং নিকি। আমি ব্যাপারটা একটু গোলমেলে হয়ে গেছে। এখানে দুজন আমি উপস্থিত।
নিকি যে কী প্রচণ্ড সমস্যায় পড়েছে তা বুঝতে পারছি। কারো দিকেই সে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। আমি তার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভাবে হাসলাম, সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আমি লক্ষ করলাম অন্য আমিও তার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভাবে হাসছে। নিকি তার কাছ থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তার ভাব দেখে মনে হল সে এখন কাঁদবে। যদি সত্যি সত্যি কাঁদে, আমি তাকে সান্ত্বনার দু-একটা কথা নিশ্চয়ই বলব। তখন অন্য আমিটি কী করবে? সেও কি সান্ত্বনার কথা বলবে? বাই তো উচিত। আমরা দুজন তো আলাদা নই।
আমি খাটের ওপর বসেছিলামৃউঠে দাঁড়ালাম। ক্লান্ত গলায় বললাম, রান্নাঘরে যাচ্ছি। তোমরা দুজম কথাবার্তা বল। এতে ব্যাপারটা সহজ হবে।
নিকি ভারি গলায় বলল, সহজ হবার কোনো দরকার নেই। তোমারও অন্য ঘরে যাবার প্রয়োজন নেই।
নিকি কাঁদতে শুরু করল। ফুঁপিয়ে খুঁপিয়ে কান্না। আমি আগে কখনো নিকিকে কাঁদতে দেখি নি। সে শক্ত ধরনের মেয়ে, সহজে ভেঙে পড়ার মতো নয়। কিন্তু সে ভেঙে পড়েছে। আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। নিকির কান্নার ছবি সহ্য করতে পারছি না।
সময় কি মাঝে মাঝে থেমে যায়? মহাবীর থর নাকি কয়েক মুহূর্তের জন্য সময় থামিয়ে দিয়েছিলেন। ওরা কি তাই করেছে? সময় কি থেমে আছে? রান্নাঘরে আমি একা একা দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে অযুত নিযুত লক্ষ কোটি বৎসর পার হয়ে যাচ্ছে, আমি দাঁড়িয়েই আছি। মাঝে মাঝে নিকির কান্নার শব্দ পাচ্ছি। সে কিছুক্ষণ পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে।
আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা চিন্তা এই সময় এল। মনে হল, যারা একই রকম দুজন মানুষ তৈরি করতে পারে, তারা তো একই রকম দুলক্ষ মানুষ তৈরি করতে পারবে, কিংবা তার চেয়েও বেশি–দু কোটি। একটি গ্রহ এক ধরনের মানুষ দিয়ে ভর্তি করে ফেলতে পারবে। অবস্থাটা তখন কী হবে? গ্রহের সবাই এক ধরনের চিন্তা করছে এবং একই ভাবে করছে, একই জিনিস নিয়ে ভাবছে। তাদের সবার ভেতর চমক্কার হৃদয়ের বন্ধন থাকবে, কারণ তারা আলাদা কেউ নয়। একই সঙ্গে একা এবং অনেকে।
আমি একটা চমক বোধ করলাম। একই সঙ্গে একা এবং অনেকে। কথাটা আমি আগে শুনেছি। ওরা আমাকে বলেছে। যেসব মহাজ্ঞানী আমাদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে তারাই নিজেদের সম্পর্কে বলেছে আমরা একই সঙ্গে একা এবং অনেকে। তাহলে তারা কি–?
আমার মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হতে লাগল। ওদের সঙ্গে যোগাযোগের এটা হচ্ছে পূর্বাবস্থা। যোগাযোগ হল।
তুমি ঠিক লাইনেই চিন্তা-ভাবনা করছ।
আমি ঠিক লাইনে চিন্তা-ভাবনা করছি কি না তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আপনি আমাকে বলুন, আপনাদের নতুন খেলার অর্থ কী?
কোনটাকে তোমরা নতুন খেলা বলছ?
আমাকে দ্বিতীয় বার তৈরি করেছেন, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
অপ্রয়োজনীয় কিছু করার মতো সময় আমাদের নেই। যা করা হয়েছে, প্রয়োজনেই করা হয়েছে। মানব সম্প্রদায়ের প্রধান ত্ৰুটি কী, তা ধরতে চেষ্টা করছি। তুমি চাইলে তোমাকে ব্যাখ্যা করতে পারি।