প্রমাণ কর।
তার জন্যে তোমাকে এক চুমুক কফি খেতে হবে। নাও আমার মগ থেকে খাও।
নিকি কফির মগে ছোট্ট একটা চুমুক দিল। আমি বললাম, কফিটা কেমন লাগছে? ভালো।
মিষ্টি ছিল না? কিছুটা।
স্বপ্নদৃশ্যে আমরা অনেক ধরনের খাবার-দাবার খাই। তার কোনোেটারই কিন্তু কোনো স্বাদ নেই।
কে বলল তোমাকে?
আমি জানি।
তুমি মাস্টারদের মতো কথা বলছ। এভাবে কথা তুমি বল না। এখন বলছ, কাজেই এটা স্বপ্ন। স্বপ্ন না হলে তোমার দেখা পাব কী করে?
নিকি, এটা স্বপ্ন নয়।
আচ্ছা ঠিক আছে, যাও এটা স্বপ্ন না। কিছু সময়ের জন্যে তোমাকে পাওয়া গেছে, আর তুমি শুরু করেছ তর্ক!
এটা যে স্বপ্ন না, এও তার একটা বড় প্রমাণ। স্বপ্নে কথা বলাবলির ব্যাপারটা কম থাকে।
আচ্ছা, ঠিক আছে বাবা, চুপ কর।
আমি চুপ করলাম। নিকি হালকা গলায় বলল, কফি শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ।
তাহলে কফির মগ রান্নাঘরে রেখে এসে আমাকে একটু আদর কর।
আমি হেসে ফেললাম। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম পুরনো আবেগ, পুরনো ভালোবাসা ফিরে আসতে শুরু করেছে। নিকিকে এখন আর পুতুল বলে মনে হচ্ছে না। কী সুন্দরই না তাকে লাগছে। পৃথিবীর জীবনে তাকে কি এত সুন্দর লাগত? নিশ্চয়ই লাগত হয়তো। তখন এত ভালো করে লক্ষ করি নি। কিংবা কে জানে এরা হয়তো তাকে আরো সুন্দর করে বানিয়েছে।
নিকিকে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। সে বুঝতে পারল কিনা জানি না, তবে চুপ করে বসে রইল। প্রতিবাদ করল না। প্রতিবাদ করলে ভালো হত, আমি আমার যুক্তিগুলি আরো গুছিয়ে তাকে বলতে পারতাম।
নিকি।
বল।
আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছ?
জানি না। বিশ্বাস করি বা না করি তাতে কিছু যায় আসে না। তুমি পাশে আছ, এই যথেষ্ট।
তুমি মনে হচ্ছে বেশ সুখী।
হ্যাঁ সুখী। কেন সুখী হব না বল? এক জন মানুষের সুখী হতে খুব বেশি কিছু কি লাগে?
না, তা অবশ্যি লাগে না।
নিকি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, তোমার মাস্টারি ধরনের কথা শুনে কান ঝাঁঝাঁ করছে। অন্য কিছু বল।
কী ধরনের কথা বলব?
ভালোবাসার কথা বল। তুমি যে আমাকে ভালোবাস এই কথাটা বল।
এটা তো তুমি জানই। নতুন করে বলার প্রয়োজন কি?
প্ৰয়োজন আছে।
আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আবার বল।
আমি তোমাকে ভালোবাসি।
থামবে না, বলতেই থাক।
নিকির চোখে জল টলমল করছে। আমি মৃদুস্বরে বারবার বলছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর সে চোখ মুছছে। আমার নিজের চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। অশ্রু খুবই সংক্রামক ব্যাপার। নিকি বলল, আর কখনো তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না।
আমি কিছু বললাম না, একটা হাত রাখলাম তার হাতে। স্পৰ্শ দিয়েও অনেক কিছুই বলা যায়। আমি নিকিকে কাছে টানলাম-ঠিক তখন ওদের সঙ্গে যোগাযোেগ হল। ওরা স্পষ্ট স্বরে বলল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
আমি চাই না।
আমরা অত্যন্ত কৌতূহল বোধ করছি। দয়া করে আমাদের প্রশ্নের জবাব দাও।
আমি কোনো কৌতূহল বোধ করছি না। আমাকে আমার বান্ধবীর সঙ্গে থাকতে দিন।
তোমার বান্ধবী দীর্ঘকাল তোমার পাশে থাকবে, আমরা থাকব না। আমরা পরিব্রাজক। আমরা বেশি সময় এক জায়গায় থাকতে পারি না। আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে।
কখন যাত্রা শুরু হবে?
খুব শিগগিরই।
আমাদের কী হবে? তোমাদের জন্যে কোনো একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।
সে ব্যবস্থাটা কী, জানতে চাই।
সময় হলেই জানবে, এখনো সময় হয় নি। এখন দয়া করে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।
আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে আমি আপনাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না।
তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন?
আমি রেগে যাচ্ছি না। আমি শুধু বলছি, আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে আমি আপনাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না।
ঠিক আছে জবাব দিও না।
কথাবার্তা থেমে গেল। মাথায় ভোঁতা ধরনের যন্ত্রণা নিয়ে আমি কালাম নিকির দিকে। নিকি বলল, কী হয়েছে?
ওরা কথা বলছিল। ওরা মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে কথা বলে। যত বারই কথা বলি, তত বারই রেগে যাই।
ওরা কি আজেবাজে কিছু বলে?
না, আজেবাজে কিছুই বলে না। তবু প্রচণ্ড রাগ লাগে। কেন তাও জানি না।
রেগে যাওয়ার স্বভাব কিন্তু তোমার ছিল না। তুমি মনে হয় খানিকটা বদলে গেছ।
খানিকটা না, অনেকখানি বদলেছি। ওরা বদলে দিয়েছে।
থাক এদের কথা, যা হবার হবে। অন্য কিছু বল।
অন্য কিছু বলব? বলার তো আর কিছু নেই।
রান্নাঘরে খুটপুট শব্দ হচ্ছে। কফি পার্কোলেটরে শব্দ হচ্ছিল, কে যেন সেটা বন্ধ করল। কাপ দেয়ার মতো শব্দ হচ্ছে। চামচ নড়ছে। কেউ এক জন কফি বানাচ্ছে রান্নাঘরে। আমি এবং নিকি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। তৃতীয় ব্যক্তি কে হতে পারে? কে কফি বানাতে বসেছে? নিকি উঠে গেল, রান্নাঘরে ঢুকল না। দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়াল। আমি দেখলাম সে মূর্তির মতো জমে গেছে। যেন তার নিঃশ্বাস পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। আমি বললাম, কী হয়েছে নিকি?
সে জবাব দিল না। নিঃশব্দে ফিরে এসে কপালের ঘাম মুছল। বসল আমার পাশে। আমি লক্ষ করলাম সে থরধর করে কাঁপছে।
কী হয়েছে নিকি?
বুঝতে পারছি না।
কী দেখলে?
নিকি জবাব দিল না। বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। তার মুখ রক্তশূন্য। আমি আবার বললাম, রান্নাঘরে কে?
তুমি যাও। তুমি দেখে এস। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি খুব সম্ভব পাগল হয়ে গেছি। আমার মাথা ঠিক নেই। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। এগিয়ে গেলাম দরজা পর্যন্ত। হ্যাঁ, আমি দেখতে পাচ্ছি। নিকির বিস্ময় ও হতাশার কারণ বুঝতে পারছি। রান্নাঘরে আমি নিজেই আছি। দ্বিতীয় আমি। ওরা আরেক জন আমাকে তৈরি করেছে। নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হওয়ার ঘটনাটা কেমন? খুবই আনন্দের কোনো ব্যাপার কি? না, আনন্দের কোনো ব্যাপার নয়। আমি তীব্র ঘৃণা নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। সেও তাকাল আমার দিকে। তার মুখে হাসি। কিন্তু বুঝতে পারছি, তার চোখেও তীব্র ঘৃণা। আমি কর্কশ গলায় বললাম, তুমি কে?