এক দিন বিদ্যুৎ চমকের মতো মাথায় একটা বুদ্ধি এল। একটা আলপিন বুড়ো আঙুলে ঢুকিয়ে দিলেই তো হয়। দেখা যাক রক্ত বেরোয় কিনা। দিলাম আলপিন ফুটিয়ে। ব্যথা পেলাম, রক্ত বেরুল। আর তখন দ্বিতীয় পরিকল্পনাটা মাথায় এল–শরীরে কোনো একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করলে কেমন হয়? টেবিলের উপর একটা কাঁচি আছে। কাগজ-কাটা কাচি। অতি সহজেই সেই কাঁচি ব্যবহার করা যেতে পারে। চোখ বন্ধ করে কাঁচির একটা মাথা পায়ের উরুতে বসিয়ে হাচকা টান দেয়া। কঠিন কোনো কাজ নয়, তবে অবশ্যই মনের জোর লাগবে। আমি দেখতে চাই। ক্ষত সৃষ্টি হবার পরপর এরা কী করে। আমার শরীর বলে যদি সত্যি সত্যি কিছু থেকে থাকে, তবে এদের তৎক্ষণাৎ এগিয়ে আসতে হবে। ওদের সঙ্গে যোগাযোগেরও একটা সুযোগ হতে পারে।
আমি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। কচি পাওয়া গেল না। যদিও অল্প কিছুক্ষণ আগেও কাঁচিটা ছিল। কিন্তু এখন নেই। কোথাও নেই। পুরোপুরি বাতাসে মিলিয়ে গেছে। আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। এরা আমাকে লক্ষ করছে। তবে এতে উল্লসিত হবার কিছু নেই। মানুষ যখন গিনিপিগ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, তখন সে গিনিপিগদের দিকে লক্ষ রাখে। খেয়াল রাখে যাতে এই গিনিপিগরা নিজেদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এরাও তাই করছে। এর বেশি কিছু নয়।
আমি বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম চোখ বন্ধ করে কোনো একটা সুখের কল্পনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু তেমন কোনো সুখের কল্পনা মাথায় আসছে না। এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে শুরু করেছি। এই রকম অবস্থায় ব্যাপারটা ঘটল। ওদের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ হল। আগেও অবচেতন অবস্থায় ওদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়েছে, আজকেরটা সে রকম নয়। এর মধ্যে কোনো রকম অস্পষ্টতা নেই। যোগাযোগের মাধ্যমে টেলিপ্যাথিক। কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছি না, কিন্তু ওরা কী বলছে, তা বুঝতে পারছি। আমি কী বলছি, তাও ওরা বুঝতে পারছে।
কীভাবে কথাবার্তা শুরু হল, তার একটা বর্ণনা দিতে চেষ্টা করি : বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধন করামাত্র মাথার বাঁ পাশে মুহূর্তের জন্যে তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্ৰণা হল। বমি ভাব হল, তা স্থায়ী হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা হালকা বোধ হতে লাগল। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে যে রকম লাগে সে রকম। তার পরপরই শুনলাম কিংবা মনে হল কেউ এক জন জিজ্ঞেস করছে, তুমি কেমন বোধ করছ? এই প্ৰশ্ন বিশেষ কোনো ভাষায় করা হল না। কিন্তু পরিষ্কার বুঝলাম ওরা জানতে চাচ্ছে আমি কেমন বোধ করছি। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ হল। আমি বললাম, ভালোই বোধ করছি।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। আবার প্রশ্ন হল। প্রশ্নের মধ্যে কোথায় যেন কিছুটা প্রশ্রয় এবং কৌতূক মেশান।
তোমরা এত সহজে এত অস্থির হও কেন?
আমার অবস্থাটা সহজ মনে করছেন কেন? অনিশ্চয়তা একটা ভয়াবহ ব্যাপার।
তোমরা বড় হয়েছ অনিশ্চয়তায়, তোমাদের জীবন কেটেছে অনিশ্চয়তায়–তার পরেও অনিশ্চয়তাকে ভয়।
আপনারা কারা?
তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আগে এক বার দিয়েছি। আবারো দিচ্ছি–আমরা পরিব্রাজক।
বুঝতে পারলাম না।
আমাদের অনেক কিছুই বুঝতে পারবে না। বুঝতে চেষ্টা করে জটিলতা বাড়াবে। তা কি ভালো হবে?
বুঝতে পারব না কেন?
তোমরা তোমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে কল্পনা করতে পার না। তোমরা যখন একটি দৈত্যের ছবি আঁক, সেগুদেখতে মানুষের মতো হয়। তোমাদের কল্পনা সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ কল্পনায় আমাদের বোঝা মুশকিল।
তবু চেষ্টা করব। পরিব্রাজক ব্যাপারটা কী?
যিনি ঘুরে বেড়ান, তিনিই পরিব্রাজক। আমরা ঘুরে বেড়াই। এক দিন যাত্রা শুরু করেছিলাম, এখনো চলছি। চলতেই থাকব।
কোথায়?
জানি না।
যাত্রা শুরু হয়েছিল কবে?
তাও জানি না।
আপনি কি একা, না আপনারা অনেকে?
আমরা একই সঙ্গে একা এবং একই সঙ্গে অনেকে।
বুঝতে পারছি না।
আগেই তো বলেছি বুঝতে পারবে না।
আপনার কি জন্ম-মৃত্যু আছে?
মৃত্যু বলে তো কিছু নেই। পদার্থবিদ্যায় পড় নি, শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই?
আপনি কি এক ধরনের শক্তি?
শুধু আমি কেন, তুমি নিজেও তো শক্তি।
আপনি বলছেন আপনি ভ্রমণ করেন। এতে কী লাভ হয়?
তোমার কথা বুঝতে পারছি না। লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন আসছে কেন?
সব কিছুরই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য কী?
জ্ঞানলাভ। আমি শিখছি।
কেন শিখছেন?
বিশ্বব্ৰাহ্মাণ্ডকে জানবার জন্য।
এই জ্ঞান দিয়ে কী করবেন?
তুমি অদ্ভুত সব প্রশ্ন করছ।
এই জাতীয় প্রশ্ন কি আপনি নিজেকে কখনো করেন না।
না। আমি দেখি। কত অপূর্ব সব রহস্য এই অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে। বড় ভালো লাগে। এই যে তোমাদের দেখা পেয়েছি, কী বিপুল রহস্য তোমাদের মধ্যে!
কী রহস্য?
এখনো পুরোপুরি ধরতে পারি নি। আরো কিছু সময় লাগবে।
শেষ পর্যন্ত আমাদের দিয়ে কী করবেন?
তোমরা যা চাও তা-ই করব কী চাও তোমরা?
যা চাই তা-ই করতে পারবেন? কেন পারব না?
পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে পারবেন?
সে তো খুবই সহজ ব্যাপার।
আপনি সত্যি বলছেন?
তাই তো মনে হয়। তুমি কি পৃথিবীতে যেতে চাও?
হ্যাঁ।
এক জন তরুণী তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে, সেই কারণে?
হ্যাঁ।
অবিকল ঐ তরুণীটিকে যদি তৈরি করে দিই, তাহলে কেমন হয়?
কীভাবে তৈরি করবেন?
একটি সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করতে প্রয়োজন হয় একটি ডিএনএ এবং একটি আরএনএ অণু। তোমার ভালোবাসার মেয়েটির একগুচ্ছ চুল তোমার সঙ্গে ছিল। সেখান থেকেই তৈরি করে দেয়া যায়।