এরা শিশু নয়।
না, তা নিশ্চয়ই নয়। এরা অতি উন্নত কোনো প্রাণী। তবে উন্নত প্রাণীর মধ্যেও শিশুসুলভ কিছু থাকে।
তাতে অসুবিধা কী? আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন, আমরা যে বেঁচে আছি তা সম্ভব হয়েছে এদের জন্যেই।
সত্যি কি আমরা বেঁচে আছি?
তার মানে?
আপনি এক জন জীববিজ্ঞানী, আমরা বেঁচে আছি কিনা তা একমাত্র আপনার পক্ষে বলা সম্ভব। বেঁচে থাকার একটি শর্ত হচ্ছে খাদ্য গ্রহণ। আপনি কখনো খাদ্য গ্রহণ করেছেন বলে কি আপনার মনে পড়ে?
ইনো জবাব দিল না। তার ভ্রূ কুঞ্চিত হল। আমি বললাম, আমার তো মনে হয় চারপাশে যা দেখছি সবই মায়া, এক ধরনের বিভ্রম।
এ রকম মনে হবার কারণ কী?
আপনি রকিং-চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন, তাই না? আপনার গায়ে কী পোশাক?
বিশেষ কোনো পোশাক নয়। সাধারণ স্কার্ট।
কিন্তু আমি আপনার গায়ে কিছু দেখছি না। আমি দেখছি অত্যন্ত রূপবতী এক জন তরুণী নগ্ন গায়ে রকিং-চেয়ারে দোল খাচ্ছে।
ইনো হকচকিয়ে গেল। আমি বললাম, এরা এইসব ছবি আমাদের মস্তিষ্কে তৈরি করছে। আমার তো মনে হয় আমরা দুজন পাশাপাশি নেই। হয়ত ওদের ল্যাবরেটরির এক কোণায় আপনার মস্তিষ্ক পড়ে আছে। অন্য প্রান্তে আমারটা। ওরা আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোন নিয়ে খেলা করছে।
ইনো চাপা গলায় বলল, আপনি কি সত্যি সত্যি আমার গায়ে কোনো কাপড় দেখতে পাচ্ছেন না?
না।
আমার তো মনে হয় আপনি সত্যি কথা বলছেন না। আমাকে ধাঁধায় ফেলে দেবার জন্যে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন।
আমি যে সত্যি কথা বলছি তা এক্ষুনি প্রমাণ করতে পারি।
প্রমাণ করুন।
আপনার শরীরের এক জায়গায় লাল রঙের এক বর্গ সেন্টিমিটার আয়তনের একটা জন্মদাগ আছে। জায়গাটা হচ্ছে।
থাক আর বলতে হবে না। প্লিজ আপনি এখন আর আমার দিকে তাকাবেন না। অন্য দিকে তাকিয়ে থাকুন।
আপনার দিকে তাকালেও কোনো ক্ষতি নেই। কারণ আমরা যা দেখছি সবই মায়া বিভ্রম। কোনোটাই সত্যি নয়।
সত্যি হোক আর না হোক, আপনি আমার দিকে তাকাবেন না।
আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ফায়ার-প্লেসের আগুন নিভে আসছে। কাঠের বড় বড় গুড়ি পুড়ে শেষ হয়েছে। শীত শীত লাগছে। বাইরে তুষারঝড়ের মাতামাতি। দমকা হাওয়ায় জানালা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইনোর রকিং-চেয়ার থেকে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। অর্থাৎ তার দুলুনি বন্ধ হয়েছে। ঘরের আলো কমে আসতে শুরু করেছে। এটা কি শুধু আমার জন্যেই, নাকি ইনোর কাছেও এ রকম মনে হচ্ছে? আমি ডাকলাম, ইনো।
বলুন শুনছি।
আমি দেখছি ঘরের আলো কমে আসছে। আপনার কাছেও কি সে রকম মনে হচ্ছে?
না।
আপনার কাছে কি আলো ঠিকই আছে?
হ্যাঁ, সবই ঠিক আছে।
তার মানে এরা আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। এখন হয়তো আমার বদলে অন্য কেউ আসবে।
হয়তো বা।
এত দিন মানুষ হিসেবে আপনারা অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এখন ওরা আমাদের নিয়ে পরীক্ষা করছে। আমরা ওদের কাছে মূল্যহীন গিনিপিগ ছাড়া আর কিছু নই।
মূল্যহীন বলছেন কেন? উল্টোটাওতো হতে পারে। হয়তো আমরা খুবই মূল্যবান।
মূল্যবান হলে ওরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত। তা কিন্তু করছে না। ওরা ওদের মতো কাজ করে যাচ্ছে। তাই নয় কি?
হ্যাঁ।
ইনো।
বলুন শুনছি, কিন্তু দয়া করে আমার দিকে তাকাবেন না।
আপনি কি লক্ষ করেছেন যে এরা শুধু সুখের স্মৃতিগুলি নিয়ে খেলা করছে। আপনার জীবনের অনেক দুঃখময় ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। সেসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। ওরা ইচ্ছা করলে ভয়ঙ্কর সব পরিবেশ তৈরি করতে পারত। পারত না?
হ্যাঁ, পারত।
তা কিন্তু ওরা করে নি।
ইনো ক্লান্ত গলায় বলল, এখনো করে নি। ভবিষ্যতে হয়তো করবে। ইনোর কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল। তন্দ্ৰা বা ঘুমের মতো কোনো একটা জগতে আমি চলে গেলাম, যে জগৎ সম্পর্কে আমার সামান্যতম ধারণাও নেই।
আমার দিন কাটছে
আমার দিন কাটছে।
কেমন কাটছে?
বলা মুশকিল। ইনোর সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নি, আমি সময় কাটাচ্ছি আমার নিজের ঘরে। কখনো বিছানায় শুয়ে থাকি, কখনো উঠে বসি, কখনো হাঁটাহাঁটি করি। কুৎসিত জীবন। মাঝে মাঝে অসহ্য বোধ হয়, ইচ্ছে করে পেঁচিয়ে বলি, দয়া করে আপনারা আমাকে মুক্তি দিন। আমি মানুষ। এ জাতীয় বন্দি জীবনে আমি অভ্যস্ত নই। ঠিক তখনি ঘরের আলো কমে আসে, আমি ঘুমিয়ে পড়ি কিংবা চেতনা বিলুপ্ত হয়, কিংবা অন্য কোনো জগতে চলে যাই। আবার একই ঘরে এক সময় জেগে উঠি, শুরু হয় পুরনো রুটিন।
কখনো কখনো মনে হয় ঘূম এবং জাগরণের এই চক্র চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। বছরের পর বছর পার হয়ে যাচ্ছে। আবার পরক্ষণেই মনে হয় না, দীর্ঘ সময় তো নয়, অল্প কিছু দিন মাত্ৰ পাইল।
কত দিন পার হল তা টের পাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। সময়ের সঙ্গে হাত ও পায়ের নখ বড় হয়। চুল লম্বা হয়। চুল কতটুকু বড় হল, বা নখ। কতটুক বড় হল, সেখান থেকে অতি সহজেই সময়ের হিসাব করা যায়। আমি তা করতে পারছি না। কারণ আমার নখ বড় হচ্ছে না বা চুলও বাড়ছে না। এটা মোটামুটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, যা আমার প্রথম দিকের সন্দেহকে দৃঢ় করে। শুরু থেকেই আমি ভাবছিলাম, আমার শরীর বলে কিছু নেই। চারপাশে যা ঘটছে তার সবটাই কল্পনা। তবে এই তথ্যেও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ আমার ক্ষুধা বা তৃষ্ণার বোধ না থাকলেও শীতবোধ আছে যা থাকার কথা নয়। নাড়ি ধরলে টিক টিক শব্দ পাওয়া যায়, যার মানে শরীরে রক্তপ্রবাহ চলছে। তাইবা কী করে হয়। ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় কীভাবে? এটা নিয়ে প্রায়ই ভাবি। কোনো কূল-কিনারা পাই না।