কী স্বপ্ন?
যেন আমি হলুদ আকাশ বইটির নায়িকা। নির্জন প্রান্তরের একটি লগ কেবিনে আমি আছি। ফায়ার-প্লেসে গগনে আগুন। বাইরে তুষারঝড় হচ্ছে। প্রচণ্ড দুৰ্যোগ। ঝড়ের গৰ্জনে কান পাতা যাচ্ছে না। অথচ ঘরের ভেতর শান্তিময় একটা পরিবেশ। এখন যে রকম দেখছেন অবিকল সে রকম। এরা আমার স্বপ্নের কথা জানতে পেরে এ রকম চমৎকার একটা পরিবেশ তৈরি করেছে।
এরা মানে কারা?
তা তো বলতে পারব না। যারা আমাদের বাঁচিয়ে তুলেছে, তারা। খুবই উন্নত কোনো প্রাণী! মহাশক্তিধর কেউ।
তাদের সঙ্গে কি আপনার কোনো কথা হয়েছে?
না। তবে তারা আমার মনের সব কথাই জানে এবং ভালোভাবেই জানে, নয়তো এরকম চমৎকার পরিবেশ তৈরি করতে পারত না। আমি যা যা চেয়েছি সবই এখানে আছে।
আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার কল্পনায় যা যা ছিল সবই এখানে পেয়েছেন।
হ্যাঁ, পেয়েছি।
আপনি কি আমাকেও চেয়েছিলেন?
তার মানে?
এই ঘর তৈরি হয়েছে আপনার কল্পনাকে ভিত্তি করে। যদি তাই হয় তাহলে আমার উপস্থিতি ব্যাখ্যা করার উপায় কী? উপায় একটিই ধরে নিতে হবে যে, আপনার কল্পনায় আমিও ছিলাম।
ইনো চেয়ার দোলানো বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রায় বরফশীতল গলায় বল, আমার কল্পনায় আপনি ছিলেন না। আমি একা একা এ রকম একটি ঘরে থাকার কথাই ভাবতাম। এটা আমার কিশোরী বয়সের কল্পনা। এক জন কিশোরীর কল্পনার সঙ্গে হয়তো আপনার পরিচয় নেই। কিশোরীর কল্পনা সাধারণত নিঃসঙ্গ হয়। একজন কিশোরী কখনো কল্পনা করে না যে, এস একজন পুরুষের সঙ্গে একটি নির্জন ঘরে রাত্রি যাপন করছে।
আমি লক্ষ করলাম ইনো বেশ রেগে গেছে। তার গলার স্বর কঠিন। মুখে রক্ত চলে এসেছে। এই মেয়ে মনে হচ্ছে খুব অল্পতেই অপমানিত বোধ করে। আমাদের এখন যে অবস্থা তাতে এত সহজে অপমানিত বোধ করার কথা নয়। আমি বললাম আপনি আমার কথা ভাবেন নি, খুব ভালো কথা। রেগে যাচ্ছেন কেন?
ইনো আগের মত ঠাণ্ডা গলায় বলল, শুরুতে আপনার কথা আমি ভাবি নি। কিন্তু পরে ভেবেছি। ভেবেছি বলেই এরা আপনাকে এখানে এনেছে।
কেন ভেবেছেন জানতে পারি?
না, জানতে পারেন না।
আমি হেসে ফেললাম। মেয়েটি কিশোরীদের মতো আচরণ করছে। অকারণে রাগছে। আমি বললাম, আপনি কি অনেক দিন ধরেই এখানে আছেন?
হ্যাঁ, অনেক দিন। তবে ঘরটা সব সময় এক রকম থাকে না। একেক সময় একেক রকম হয়। এরা আমার কল্পনা নিয়ে খেলা করে। মূল ব্যাপারটা ঠিক রেখে একেক সময় একেক রকম করে পরিবেশ তৈরি করে। চমৎকার ব্যাপার!
আপনার মনে হয় বেশ মজা লাগছে।
লাগারই তো কথা। যেখানে মরতে বসেছিলাম, সেখানে দিব্যি বেঁচে আছি। যারা আমাদের বাঁচিয়েছে, তাদের খুব খারাপ প্রাণী বলেও আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমাদের মোটামুটি সুখেই রেখেছে। আশা করা যাচ্ছে ভবিষ্যতেও রাখবে।
ইনো বেশ শব্দ করে হাসল। তার সঙ্গে এর আগে এক বার মাত্র আমার কথা হয়েছে। অল্প কিছু সময় কথা বলে এক জন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। মানুষ অত্যন্ত রহস্যময় প্রাণী, তাকে বুঝতে হলে দীর্ঘদিন তার পাশাপাশি থাকতে হয়। ইনোর পাশাপাশি ধাকার মতো সুযোগ আমার হয় নি। তবু আমার মনে হল এই ইনো ঠিক আগেকার ইনো নয়। সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন তার মধ্যে হয়েছে, যা আমি ধরতে পারছি না। তারা নানান রকম পরিবেশ তৈরি করেছে। পরিবেশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। যদি তাই হয় তাহলে মানুষ নিয়েও কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে না? হয়তো একেক বার একেক ধরনের ইনো তৈরি করছে। নষ্ট করে ফেলছে, আবার তৈরি করছে।
আমি হালকা গলায় বললাম, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এরা আমাদের তৈরি করেছে। আপনি নিজে এক জন জীববিজ্ঞানী। জীববিজ্ঞানী হিসেবে আপনি বলুন, তৈরি করার কাজটিতে তারা কেমন সফল?
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
আপনাকে এরা নতুন করে তৈরি করেছে। কারণ ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর আপনি এবং আমাকে সবাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। তাই নয় কি?
হ্যাঁ, তাই।
যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আমাদের আবার তৈরি করার মতো জটিল কাজটি এরা চমৎকার ভাবে করেছে। তবু আমার মনে হচ্ছে আমরা ঠিক আগের মতো নই। আপনার কি তা মনে হয় না?
ইনো হেসে ফেলে বলল, আগে হচ্ছিল না, এখন হচ্ছে। আপনার বকবকানি শুনে মনে হচ্ছে। আপনার এ রকম বকবকানি স্বভাব আগে ছিল। না।
ইনো খিলখিল করে হেসে উঠল। সেই হাসি আর থামতেই চায় না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। সেই পানি সে মুছল না। চমৎকার ছবি। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। ইনো বলল, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
আমি বললাম, আপনাকে কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
অবশ্যই পারেন। তবে প্রশ্নের উত্তর দেব কি দেব না তা আমার ইচ্ছা। কী প্রশ্ন?
কিশোরী বয়সে আপনি একটি উপন্যাস পড়েছিলেন। যে উপন্যাসের নায়িকা এ রকম একটা লগ কেবিনে একা একা থাকত, তাই না?
হ্যাঁ।
সেও কি মাঝে মাঝে খুব হাসত? হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে যেত কি?
হ্যাঁ। কেন জিজ্ঞেস করছেন?
আপনিও অবিকল সে রকম রেছেন। আপনার মানসিকতা ঐ মেয়েটির মতো হয়ে গেছে। অর্থাৎ এরা আপনাকে বদলে ফেলেছে।
তাতে অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নেই। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এরা আমাদের নিয়ে খেলছে। এক জন শিশুকে খানিকটা কাদা দিলে শিশুটি কী করে? একেক সময় একেক রকম খেলনা বানায়। কোনোটাই তার পছন্দ হয় না। ভাঙে এবং তৈরি করে।