শেলফের বইয়েরও একই অবস্থা। বেশির ভাগ বইয়েরই সব পৃষ্ঠা সাদা। অবশ্যি কিছু কিছু বই পাওয়া গেল যেগুলিতে লেখা আছে। একটি বইয়ের ত্রিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লেখা, বাকি পাতাগুলি সাদা। এর মানে কী?
আমি জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। কী অদ্ভুত কাণ্ড, জানালার ওপাশে ঘন অন্ধকার–কিছুই নেই। আমার এই ঘরটি ছাড়া ব্ৰহ্মাণ্ডে যেন আর কিছু নেই। এর কোনো মানে হয় না। এটা গভীর রাত হলেও বাইরে লোকজন চলাচল করবে। স্ট্রিট লাইট জ্বলবে। কিন্তু এটা রাত নয়, কারণ আমার ঘরে বাতি জ্বলছে না, অথচ ঘরের ভেতর দিনের মতো আলো। আমার খাটে তেরছা করে সূর্যের আলো পড়েছে, অথচ বাইরে কোনো সূর্য নেই।
আমি উঁচু গলায় বললাম, এসব কী হচ্ছে? কেউ আমার কথার জবাব দেবে ভাবি নি, কিন্তু জবাব পেলাম। কোনো শব্দ হল না, অথচ পরিষ্কার বুঝলাম কেউ এক জন বলছে, তোমার ঘরটি কি আমরা ঠিকমতো তৈরি করি নি?
আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে? তুমি কে?
আমি কে তা জানতে পারবে। তার আগে বল কেমন বোধ করছ?
আমি কি বেঁচে আছি?
নিশ্চয়ই বেঁচে আছ, তোমাকে বাঁচিয়ে তুলতে খুবই কষ্ট করতে হয়েছে। তোমার বেশির ভাগ অঙ্গপ্রত্যঙ্গই নতুন করে তৈরি করতে হয়েছে। এটা তেমন কোনো জটিল ব্যাপার নয়, তবুও খুব ক্লান্তিকর দীর্ঘ ব্যাপার।
আমি আমার চারপাশে যে সব দেখছি, তা কি আমার কল্পনা না সত্যি সত্যি দেখছি?
যা দেখছ সত্যি দেখছ। এইসব জিনিসের স্মৃতি তোমার মস্তিষ্কের কোষে, যাকে তোমরা বল নিউরোন সেখানে ছিল। আমরা তা দেখে দেখেই তোমার চারপাশের পরিবেশ তৈরি করেছি। তুমি একটু আগেই লক্ষ করেছ কিছু কিছু বইয়ের পাতা সাদা। ঐ বইগুলি তুমি পড় নি, কাজেই তোমার মাথায় কোনো স্মৃতি নেই। আমরা যে কারণে লেখা তৈরি করতে পারি নি। যেসব বই পড়েছ, তাঁর স্মৃতি তোমার আছে। কাজেই সেসব তৈরি করা হয়েছে। আমি কী কলছি বুঝতে পারছ?
না, পারছি না।
ধীরে ধীরে বোঝই ভালো। তোমার মস্তিষ্ক এখনো পুরোপুরি সবল হয় নি। আরো কিছু সময় যাক।
তোমরা কে?
এখনো বুঝতে পারছ না?
না।
বুঝবে, সময় হলেই বুঝবে।
আমার সঙ্গীরা কোথায়?
সবাই ভালো আছে।
তিশ-২ নামের একটি রোবট ছিল–।
তাকেও ঠিকঠাক করা হয়েছে।
তোমরা কি বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী?
প্রাণী বলতে তোমরা যা বোঝ, আমরা সে রকম নই। আমাদের জন্ম ও মৃত্যু নেই।
তা কী করে হয়।
কেন হবে না? একটি আঙটির কথাই ধর। আঙটিটির কোনো শুরু নেই আবার শেষও নেই। তাই নয় কি?
তোমরা দেখতে কেমন?
এই প্রশ্নের জবাব আমরা জানি না। আমরা লক্ষ করেছি দেখার ব্যাপারটিতে তোমরা খুব জোর দিচ্ছ। এই ব্যাপারটা কী, সেই সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। এখন তুমি বিশ্রাম নাও।
আমার চারদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে পরিচিত ঘর অদৃশ্য। চারপাশে অন্ধকার, গাঢ় অন্ধকার। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, কিংবা আমার চেতনা বিলুপ্ত হল। কী হল ঠিক জানি না।
মানুষের বিস্মিত হবার সীমা
মানুষের বিস্মিত হবারও একটা সীমা আছে।
সীমা অতিক্রম করবার পর সে আর কোনো কিছুতেই বিস্মিত হয় না। আমার বেলায়ও তাই হয়েছে। বিস্মিত হবার ক্ষমতা অতিক্রম করেছি। চোখের সামনে যা দেখছি, তাতে আর অবাক হচ্ছি না। আমার জীবন এখন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে আছে নিদ্রা এবং জাগরণ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকছি, আবার জেগে উঠছি। জাগছি বিশেষ বিশেষ পরিবেশে। অকল্পনীয় সব দৃশ্য দেখছি, কিন্তু এখন আর অবাক হচ্ছি না।
এই মুহূর্তে আমার জাগরণের কাল চলছে। আমি এখন আছি একটা ছোট্ট কাঠের ঘরে। পুরনো ধরনের ঘর। পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক আগের পৃথিবীর মানুষরা যে রকম ঘর বানাত অবিকল সে রকম লগ কেবিন। একটি জ্বলন্ত ফায়ার-প্লেস আছে। বড় বড় কাঠের গুঁড়ি ফায়ার-প্লেসে পুড়ছে। ঘরে পোড়া কাঠের ঝাঁঝালো গন্ধ। একটিমাত্র কাচের জানালা। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বাইরের অঞ্চলটি কোনো পার্বত্য অঞ্চল নয়। সমভূমি। দিগন্তবিস্তৃত বরফ ঢাকা মাঠ। আকাশ ধোঁয়াটে। প্রচুর তুষারপাত হচ্ছে। তুষারঝড় শুরু হবার আগের অবস্থা।
ফায়ার-প্লেসের সামনে একটি রকিং চেয়ারে বসে আছে ইনে। তার মুখ হাসি-হাসি। মনে হচ্ছে তার আনন্দের সীমা নেই। ইনো আমাকে দেখে চেয়ার দোলন বন্ধ করে রহস্যময় গলায় বলল, পরিবেশটা কেমন লাগছে বলুন তো? চমৎকার না?
আমি কিছু বললাম না। ইনো হালকা গলায় বলল, আপনি মনে হচ্ছে। মোটেই অবাক হচ্ছেন না। আপনার কাছে সব কিছুই মনে হয় বেশ স্বাভাবিক লাগছে।
কথার পিঠে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু বললাম, আপনি বেঁচে আছে দেখে আনন্দ লাগছে। দুর্ঘটনার পর এই প্রথম সঙ্গীদের কোনো এক জনের সঙ্গে দেখা হল।
ইনো বলল, আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে না আপনি আমাকে পেয়ে আনন্দে আটখানা হয়েছেন। কেমন কঠিন মুখ। বসুন আমার পাশে, গল্প করি। কে জানে এক্ষুণি হয়ত সব অদৃশ্য হয়ে যাবে। বলতে বলতে সে শব্দ করে হাসল। আমি ইনোর পাশে বেতের নিচু চেয়ারটায় বসলাম। ফায়ার-প্লেসের আগুনের আঁচ এখন একটু বেশি। সরে বসলেই হয়, কিন্তু সরে বসতে ইচ্ছে করছে না। মাঝে মাঝে নিজেকে কষ্ট দিতেই বেশি ভালো লাগে। ইনো আবার দোল খেতে শুরু করছে। মাথার দুপাশ থেকে দুটি লম্বা বেণী দুলছে। ইনোর মাথায় কখনো বেণী দেখি নি। সে এখানে চুল বেঁধে বেণী করেছে তাও মনে হয় না। তার গায়ের পোশাক, সাজসজ্জা–সবই অন্য কেউ করে দিচ্ছে। ইনো কি ব্যাপারটা লক্ষ করছে? তার ভাবভঙ্গি দেখে তা মনে হয় না। চোখ আধবেঁজা করে সে ক্রমাগত দোল খেয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থাতেই সে নরম গলায় বলল, খুব ছোটবেলায় আমি একটা বই পড়েছিলাম। বইটার নাম হলুদ আকাশ। সেই বইয়ের নায়িকা একা একা একটা বাড়িতে থাকত। ফায়ার-প্লেসের সামনে রকিং চেয়ারে বসে দোল খেত। আমি তখন থেকেই একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।