আমি উত্তর দেবার আগেই তিন নম্বর লালবাতি জ্বলে উঠল। চরম বিপর্যয়ের শেষ সংকেত। তার পরপরই মহাকাশযানের কৃত্রিম মাধ্যাকৰ্ষণ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম স্তরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হল। এর মধ্যেই আমি মিশন প্রধান জন বগের গলা শুনলাম, আসুন আমরা এই বিপর্যয়ের নামে মদ্যপান করি।
তাঁর কথা শেষ হল না, তৃতীয় স্তরে আরেকটি বিস্ফোরণ হল। আগুনের নীল শিখা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের গ্রাস করল।
এর পরের কথা আমার আর কিছু মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়।
গাঢ় অন্ধকার
অন্ধকার।
গাঢ় অন্ধকার।
আলো ও শব্দহীন অনন্ত সময়ের জগৎ। আমার কোনো রকম বোধ নেই। বেঁচে আছি কিনা তাও বুঝতে পারছি না। এটা কি মৃত্যুর পরের কোনো জগৎ? অন্য কোনো জীবন? আমার মধ্যে সর্বশেষ স্মৃতি যা আছে, তা হচ্ছে একটি বিভীষিকার স্মৃতি। চারদিকে লেলিহান শিখা। গ্যালাক্সি-টু নামের অসাধারণ মহাকাশযানটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সব স্মৃতি তো এইখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার পরেও মনে হচ্ছে চেতনা বলে একটা কিছু এখনো আমার মধ্যে আছে। সব শেষ হয় নি, কিংবা শেষের পরেও কিছু আছে।
আমি চিৎকার করতে চাই, কোনো শব্দ হয় না। হাত-পা নাড়তে গিয়ে মনে হয় আমার হাত-পা বলে কিছু নেই। চারদিকে সীমাহীন শূন্যতা। আমার চেতনা শুধু আছে, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তা কী করে হয়! অন্ধ ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমি প্রাণপণ শক্তিতে চিৎকার করতে যাই, তখন মনে হয় কেউ একজন যেন আমাকে ভরসা দেয়। আমি তার কণ্ঠ শুনতে পাই না, উপস্থিতি বুঝতে পারি না–কিন্তু তবুও মনে হয় কেউ এক জন পরম মমতায় আমাকে লক্ষ করছে। বলছে, ধৈর্য ধর। সহ্য কর। আমি আছি। আমি পাশেই আছি।
কে, তুমি কে?
ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও।
আমি কি জীবিত না মৃত
সহ্য কর।
কী সহ্য করব আমার তো কোনো শারীরিক কষ্ট হচ্ছে না। শরীর বলে কি আমার কিছু নেই
ঘুমিয়ে পড়। ঘুমিয়ে পড়।
ঘুমিয়ে পড়তে বলছ কেন আমি কি জেগে আছি
ঘুমিয়ে পড় ঘুমিয়ে পড়। দীর্ঘ ঘুম। নিরবচ্ছিন্ন ঘুম।
তুমি কে?
আমি কোনো জবাব পাই না। তখন মনে হয় সমস্তটাই কি কল্পনা তাইবা হবে কী করে আমি কল্পনা করছি কীভাবে, একজন মৃত মানুষ কি কল্পনা করতে পারে, কীভাবে করে, কল্পনা ছাড়া সে কি অন্য কিছু করতে পারে না, আমার বাকি জীবন কি কল্পনা করে করেই কাটবে অযুত নিযুত লক্ষ কোটি বৎসর ধরে আমার কাজ হবে শুধু কল্পনা করা অনন্ত মহাশূন্যে ঘুরে বেড়ান। আমি কি তাই করছি ঘুরে বেড়াচ্ছি মহাশূন্যে
কোনো কূল-কিনারা পাই না। এক সময় যে চেতনা অবশিষ্ট আছে, তাও লোপ পায়। গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ি। আমার মনে হয় অনন্তকাল কেটে যায় ঘুমের মধ্যে। আবার ঘুম ভাঙে। আমি ভয়ে ভয়ে বলি, কে কোনো শব্দ হয় না। চারদিকে দেখি, ঘন অন্ধকার। ক্ষীণ স্বরে বলি, আমি কোথায়
আবার আগের মতো কেউ আমাকে ভরসা দেয়। তার কথা শুনতে পাই না। তাকে দেখতে পাই না, কিন্তু অনুভব করি, সে বলছে, ভয় নেই। কোনো ভয় নেই।
কে তুমি কে
ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও। আমরা তোমার পাশেই আছি।
তোমরা কারা
সময় হলেই জানবে।
কখন সময় হবে
হবে, শিগগিরই হবে। ঘুম এবং জাগরণের আরো কয়েকটি চক্র পার হতে হবে।
আমার সঙ্গীরা কোথায়
এর কোনো জবাব পাওয়া যায় না। আমার চেতনা আবার আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কী ভয়ঙ্কর জটিলতা। আমি কাতর কণ্ঠে বলি, অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না। আলো চাই সামান্য কিছু আলো।
ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও। অপেক্ষা কর।
আমি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে করতেই হয়তোবা নিযুত লক্ষ কোটি বছর পার হয়ে যায়, কিংবা কে জানে এই জাগতে হয়তো সময় বলে কিছু নেই।
হয়তো আমার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর নতুন একটি অবস্থায় আমি আছি। এই অবস্থায় শরীর নেই, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কিছুই নেই, আছে শুধু চেতনা। এই চেতনা নিয়ে আমি ভেসে আছি অনন্ত মহাশূন্যে। আমার চারপাশে বিপুল অন্ধকার, নৈঃশব্দের ভয়াবহ মহাশূন্য…
মনে হচ্ছে বেঁচেই আছি
আমি মনে হচ্ছে বেঁচেই আছি।
মনে হচ্ছে বলছি কারণ আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। বড়ো রকমের একটা জট কীভাবে যেন লেগে আছে, জট খুলতে পারছি না। হয়তো পাগল-টাগল হয়ে গেছি। কোনো ইন্দ্ৰিয় ঠিকমতো কাজ করছে না। কিংবা মৃত মানুষদেরও হয়তো চেতনা বলে কিছু আছে। অদ্ভুত সব দৃশ্য সে দেখে এবং অদ্ভুত সব শব্দ সে শোনে।
যেসব ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেছে, আমি সেসব সাজাতে পারছি না। মহাকাশযানে করে যাচ্ছিলাম। গন্তব্য এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ। একটা দুর্ঘটনা ঘটল। ভয়াবহ দুর্ঘটনা। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। দুর্ঘটনায় আমার জীবনের ইতি হয়ে যাবার কথা। তাও হল না। মনে হল খানিকটা চেতনা অবশিষ্ট আছে। মাঝেমধ্যে কে যেন আমায় সান্ত্বনা দেয়, বলে, ধৈর্য ধর, আমরা আছি। কে বলে? জানতে পারি না, কারণ চারদিকে গাঢ় অন্ধকার।
এখন অন্ধকার নেই, আমি সব কিছু পরিস্কার দেখতে পারছি। তবে যা দেখছি তা বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে, যে জট লেগেছে তা কেনো দিন খুলবে না। কারণ আমি চারপাশে দেখছি আমার পরিচিত জগৎ। আমার এ্যাপার্টমেন্টের সাত তলার ঘর। কোঁচকান বিছানার চাদরের এক কোণায় কফির দাগ লেগে গিয়েছিল, সেই দাগও আছে। বাথরুমের শাওয়ারটা নষ্ট। সব সময় ঝিঝির করে পানি পড়ে। এখনো পড়ছে, শব্দ শুনছি। খাটের পাশে শেলফে অনেকগুলি বই। মেঝেতে একটা পেপারব্যাক বই পড়ে আছে, নাম দি ওরিওনা ভৌতিক উপন্যাস। কিনে এনেছিলাম, কিন্তু এক পৃষ্ঠাও পড়ি নি। খুব নাকি চমৎকার বই। নিকি পড়েছে। তার ধারণা এটা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বই। এ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে চলে আসবার সময় বইটি যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। আমার জন্যে এর চেয়েও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বইটি হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখি প্রতিটি পৃষ্ঠা সাদা।