বছির কি শুধু ইহাই ভাবিতেছিল? নিজের মনের দুর্বলতার কথা কি তাহার মনে পড়িতেছিল না? কলমী ফুলের মত লাল টুকটুকে মুখ ফুলীর! আবার যদি সে দেখে তার জীবনের সকল সঙ্কল্পের কথা সে ভুলিয়া যাইবে। না-না ইহা কখনো হইতে পারিবে না। কঠোর হইতে কঠোরতর তাহাকে হইতে হইবে।
কিন্তু এমন হইতে পারে না? তাহা দেশে আসিয়া ফুলুকে সঙ্গে করিয়া সে নতুন সংসার পাতিবে।….উঠানের উপর ফুল এ-কাজে ওকাজে ঘুরিবে; উঠান ভরিয়া কলমী ফুল ছড়াইয়া যাইবে। রান্নাঘরে পাটাপুতা লইয়া সে হলুদ বাটিবে। তাহার গায়ের রঙের সঙ্গে আড়াআড়ি করিয়া পাটা ভরিয়া হলুদের রঙ ছড়াইবে। না–না–না। একি ভাবিতেছে। বছির? আজ সে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াইতেছে। তাহার জীবনের বড় হওয়ার ক্ষুধা এখনো মেটে নাই। এখনও তার অথই গাঙের তরী পাড়ের ঘাটে আসিয়া ভেড়ে নাই। এসব সুখের কথা তাহার ভাবিতে নাই। তবুও একবার যদি ফুলুর সঙ্গে দেখা হইত! সেই লাল নটে পাতার মত ডুগুডুগু মেয়েটিকে যদি আর একবার সে চোক্ষের দেখা দেখিয়া যাইতে পারিত; সেই স্বপ্ন চক্ষে পুরিয়া বছির তার ভবিষ্যতের অনিশ্চিত দিনগুলিকে রঙিন করিয়া লইতে পারিত। কিন্তু তাহা যে হইবার নয়।
যাইবার আগে বছির বড়ুর কবরের পাশে আসিয়া বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিল। ফুলু কবরের মাটিতে মাথা খুড়িয়া ফেঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছে।
ধীরে ধীরে যাইয়া বছির ফুলুর হাত দুইখানা ধরিয়া তাহাকে উঠাইল। তারপর তাহার মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “ফুল! আমার সোনা বইন! আমি জানি সেদিন তোমারে অবহেলা কইরা তোমার মনে আমি বড় ব্যথা দিছি। কিন্তুক একথা জাইন বইন। তোমার ভালর জন্যিই আমারে অমন করতি ঐছে। আমি দোয়া করি। তোমার জীবন যেন সুখের হয়। এই কথা মনে রাইখ, তোমারে যে দুস্ক, আমি দিয়া গেলাম তার চাইতে অনেক দুস্ক আমি আমার মনের মদ্দি ভইরা লয়া গেলাম।”
কাঁদিতে কাঁদিতে ফুলু বলিল, “বছিরবাই! তোমার পায়ে পড়ি। আমার ভালর কথা তুমি আর কইও না। তুমি এহন যাও। আমারে মনের মত কইরা কানতি দাও। কবরে যে ঘুমায়া আছে সেই একজন ক্যাবল আমার কান্দন শুনতি পায়।”
এই বলিয়া ফুলী কাঁদিয়া ভাঙিয়া পড়িল।
অনেক্ষণ সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে বছির সেখান হইতে চলিয়া গেল।
আহা! এই বনের হরিণী! ওকে কাঁদিতে দাও। বুকের বোবা কাহিনী যাহার কহিবার ভাষা নাই, সে যদি কাঁদিয়া কিছুটা সান্ত্বনা পায় তাহাকে কাঁদিতে দাও!
–সমাপ্ত–