বছিরভাই তাহাকে অবহেলা করিয়াছে। তাহাতে তাহার কি আসে যায়? সেও আর বছিরভাইর নাম মুখে আনিবে না। কিন্তু এ কথা ভাবিতে কোথাকার সাত সাগরের কান্নায় তার বুক ভাসিয়া যায়। কি যেন তাহার সর্বনাশ হইয়াছে! কোথায় যেন তার কত বড় একটা ক্ষতি হইয়াছে! সে ক্ষতি হয়ত সারা জীবনেও আর পূরণ হইবে না! কিন্তু কিসের ক্ষতি হইয়াছে, কে সেই ক্ষতি করিয়াছে কিছুই সে বুঝে না। বন-হরিণীর মত বনের এ পথে সে পথে সে ঘুরিয়া বেড়াইল। তারপর বড়র কবরের পাশে আসিয়া কান্দিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল। এই কবরের মাটির মতই সে মূক। তাহার বেদনার কথা পৃথিবীর কেহই কোনদিন জানিবে না। তাই এই কবরের মূক-মাটির উপর বসিয়া সে অঝোরে কাঁদিতে লাগিল।
কিন্তু মূক-মাটি কথা কহে না। মাটির তলায় যে ঘুমাইয়া আছে সেও কথা কহে না।
বড়ু! তুই আর কত কাল ঘুমাইবি? তুই–শুধু তুই আমার কথা বুঝিতে পারিবি। মাটিতে মাথা ঘসিয়া ঘসিয়া ফুলী সমস্ত কপাল ক্ষত-বিক্ষত করিয়া ফেলিল। এ মাটি কথা বলে না। তবু এই মাটির কবরের উপর বসিয়া কাদিতে তাহার ভাল লাগে। মাটি যেন তাহাকে চেনে। বড় শীতল এই মাটি। তার বুকে বুক মিশাইলে বুক জুড়াইতে চাহে।
“মাটি! তুই আমারে জায়গা দে। যেখানে বড় ঘুমাইয়া আছে তারই পাশে আমাকে স্থান দে। আমরা দুই বন্ধুতে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া বছিরভাইর স্বপ্ন দেখিব। হয়ত মাঝে মাঝে বছিরভাই এখানে আসিয়া দাঁড়াইবে। আমার কথা মনে করিয়া আসিবে না। কিন্তু বড়ু! তোকে সে কোনদিন ভুলিবে না। তোর কথা মনে করিয়া সে যখন এখানে আসিয়া দাঁড়াইবে, কবরের ঘুমে বসিয়া আমি তার চাঁদ মুখখানা দেখিতে পাইব। বড়–আমার পরানের সখি বড়–তুই আমারে সঙ্গে নে।”
.
৪১.
বছির এখনই লণ্ডনের পথে রওয়ানা হইবে! আজাহেরের উঠানে ভর্তী লোক। ভাসান চর হইতে আরজান ফকির আর তার স্ত্রী আসিয়াছে। আলীপুর হইতে রহিমুদ্দীন কারিকর আসিয়াছে। গরীবুল্লা মাতবর, মিঞাজান, তাহের, গ্রামের সকল লোক আসিয়া আজাহেরের উঠানখানা ভর্তী করিয়া ফেলিয়াছে। বছির সকলকে সালাম জানাইয়া বলিল, “আমি আইজ নিরুদ্দেশের পথে রওয়ানা ঐলাম। আপনারা দোয়া করবেন, ফিরা আইসা যেন আপনাগো খেদমত করতি পারি।”
গণশা আওগাইয়া আসিয়া বলিল, “ভাই-বছির! হেই কথা যিনি মনে থাহে। তুমি আইসা এমুন একটা স্কুল বানাইবা যেহানে মাষ্টারের মাইর থাকপি না।”
বছির বলিল, “গণেশভাই! তোমার কথা আমার মনে আছে। তুমি আমার পরথম গুরু। তুমি আমার মনে বড় হওয়ার আশা জাগাইয়া দিছিলা। আল্লায় যদি আমারে দ্যাশে ফিরাইয়া আনে, তোমার মনের মত একটা ইস্কুল আমি গইড়া তুলব।”
তারপর বছির আরজান ফকিরের পদধুলি লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ফকির সাহেব। তুমি ত আইজ আমারে কুনু কথা কইলা না?”
আরজান ফকির তাহাকে দোয়া করিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে বলিল, “বাজানরে! মনের কথা কি মুহে কওন যায়? বুকের কথা বুকের মদ্দি ভইরা দিতি
অয়। এতদিন তোমারে আমার ঘরে রাইখা আমার যত কথা সারিন্দার সুরি সুরি তোমার বুকের মদ্দি ভইরা দিছি। সে কথার ফুল ফোটে–সে কথার ফল ধরে। সেই ফলের আশায়ই আমি বইসা থাকপ যতদিন তুমি ফিরা না আস।”
বছির বলিল, “বুঝতি পারলাম ফকিরসাব! এতদিন তোমার বাজনা আর গান শুইনা তোমার গায়ালী সব কিছুর উপর আমার মনের ভালবাসা জাগায়া দিছাও। আমি যদি শক্তিবান হয়া ফিরতি পারি, তখন এমন দিন ডাইকা আনব, যহন তোমার হাতের সারিন্দা আর কেউ ভাঙতি পারবি না। তোমার গায়ালী গান, নকসা যা কিছু গাওগেরামের বাল সেগুলাকে উপরে তুইলা ধরব।”
ফকির উত্তর করিল, “বাজান! গল্পে শুনছি অসুর কুলির এক ছেলে দেবতাগো দ্যাশে যায়া অমরত লয়া আইছিল। তেমনি তোমারে পাঠাইলাম সেই দূরদেশে। আমরা সব মইরা গেছি। সেইহানগুনা অমরত আইনা আমাগো সগলরে তুমি বাঁচাইবা। তুমি একা বড় ঐলে ত চলবি না বাজান! আমাগো সগলরে তোমার মত বড় বানাইতি অবি।”
গরীবুল্লা মাতবর বলিল, “বাবা বছির! তুমি যতদিন ফিরা না আইবা আমরা তোমার পথের দিগে চায়া থাকপ। আর মনে করব, তুমি ফিরা আইসা আমাগো সগল দুষ্ণু দূর করবা। বাজানরে! আমরা বোবা। দুস্কের কথা কয়া বুঝাইতি পারি না। তাই আমাগো জন্যি কেউ কান্দে না। তোমারে আমরা আমাগো কান্দার কান্দুইনা বানাবার চাই। এই গিরাম ঐল কাটার শয্যা। এই হানে আইসা তোমারে বেগুম রাইত কাটাইতি অবি। আমরা মরা। আমাগো বাঁচাইতি ঐলি তোমারে এহানে আইসা মরার আগে মরতি অবি। মান সম্মান ইজ্জত সব কিছু ছাইড়া আমাগো সাথে মাটির উপর আইসা বসতি অবি।”
সামনে ফকির-মা বসিয়াছিল। তাহার কাছে যাইয়া সালাম করিতে ফকির মার দুইটি চোখ অশ্রুতে ভরিয়া গেল। বছির সকলকে দেখাইয়া বলিল, “এই আমার ফকির মা। পশ্চিমা যেমন ঠোঁটের আধার দিয়া বাচ্চাগো পালন করে তেমন কইরা নিজে না খায়া এই মা আমারে খাওয়াইছে।”
ফকির মা বলিল, “আমার গোপাল! আমার যাদুমণি! তুমি স্বর্গপুরী থইনা আমার ভাঙা ঘরে আইসা উদয় হৈছিলা। আজ মায়ের কোল ছাইড়া তুমি গোচারণ চইলা যাও। আমি পথের দিকে চায়া থাকপ কতক্ষণে আমার গোপাল ফিরা আসে।”
একে একে সকলেই বিদায় লইয়া চলিয়া গেল। বছিরের কেবলই ইচ্ছা করিতেছিল যাইবার আগে একবার ফুলুর রাঙা মুখোনি দেখিয়া যায়। সেই যে সেদিন ফুল চলিয়া গিয়াছে, অভিমানী মেয়ে আর ফিরিয়া আসে নাই। তাহার অবহেলা না জানি তাকে কতইনা আঘাত করিয়াছে। যাইবার আগে তাহাকে দুইটি মিষ্টি কথা বলিয়া গেলে হয় না? কাছে ডাকিয়া আগের মত বোনটি বলিয়া একটু আদর করিয়া গেলে চলে না? কিন্তু তা করিতে গেলে হয়ত তাহার বালিকা-মনে বছির যে আশঙ্কা করিতেছে, সেই ভালবাসার অঙ্কুর রোপণ করিয়া যাইতে হইবে। অভাগিনী ফুলুর সারাটি জীবন হয়ত তাহাতে ব্যর্থ হইয়া যাইবে।