এই সরলা গ্রাম্য-বালিকার মনে সে যদি আজ তার প্রতি এতটুকুও আকর্ষণের ফুল ফুটিবার সুযোগ দেয় তবে যে জাহান্নামেও তার স্থান হইবে না।
ফুলী অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া বলিল, “কি বছিরবাই! কথা কও না ক্যান? কাল । রাইতিই আমি তোমার সঙ্গে দেখা করবার আসত্যাছিলাম।”
বছির বলিল, “মা ওইখানে পাকের ঘরে আছে। যাও ফুলী। মার কাছে যাও।”
“তা তো যাবই বছিরবাই। কিন্তুক কাইল রাইতি আইলাম না ক্যান হেই কথাডা আগে কই। তোমার জন্যি আইজ ছয়মাস ধইরা একখানা কাঁথা সিলাই করত্যাছিলাম। আইজ সারা রাইত জাইগা এডারে শেষ করলাম। দেখত বছির বাই কেমন ঐছে?”
এই বলিয়া ফুলী তার আঁচলের তলা হইতে কাঁথাখানা মেলন করিয়া ধরিল। দেখিয়া বছির বড়ই মুগ্ধ হইল। কোন শিল্প বিদ্যালয়ের শিক্ষা পাইয়া এই গ্রাম্য মেয়েটি অঙ্কন পদ্ধতির সীমা-পরিসীমার (Proportion) জ্ঞান লাভ করে নাই। নানা রঙ সামনে লইয়া এ-রঙের সঙ্গে ওরঙ মিশাইয়া রঙের কোন নতুনত্বও সে দেখাইতে পারে নাই। ছেঁড়া কাপড়ের পাড় হইতে লাল, নীল, হলুদ ও সাদা–মাত্র এই কয়টি রঙের সূতা উঠাইয়া সে এই নক্সাগুলি করিয়াছে। শিল্প-বিদ্যালয়ের সমালোচকেরা হয়ত ইহার মধ্যে অনেক ভুলত্রুটি ধরিতে পারিবেন কিন্তু তাহার সাধারণ সৌন্দর্য অনুভূতি লইয়াই সে বুঝিল এমন শিল্পকার্য সে আর কোথাও দেখে নাই। কাঁথার মধ্যে অনেক কিছু ফুলী আঁকে নাই। শুধু মাত্র একটি কিশোর-রাখাল বাঁশী বাজাইয়া পথে চলিয়াছে। আর একটি গ্রাম্য-মেয়ে কাঁখে কলসী লইয়া সেই বাঁশী মুগ্ধ হইয়া শুনিতেছে। পুকুরে কয়েকটি পদ্মফুল ভাসিতেছে। তাহাদের দলগুলির রঙে বংশীওয়ালার প্রতি সেই মেয়েটির অনুরাগই প্রকাশ পাইতেছে। বছির বুঝিল, তার জীবনের সুদীর্ঘ পথের কাহিনী বাঁশীর সুরে ভাসিয়া বহুকাল ধরিয়া ওই জল-ভরণ-উদ্যতা মেয়েটির অন্তরে প্রবেশ করিতেছে। তারই মনের আকুতি রূপ পাইয়াছে ওই চলন্ত মাছগুলির মধ্যে, ওই উড়ন্ত পাখিগুলির মধ্যে এই ক্ষুদ্র কাঁথার উপরে ফুলী এতগুলি নক্সা এবড়ো থেবড়ো ভাবে বুনোট করে নাই। যেখানে যে নকসাটি মানায়—যে রঙটি যে নকসায় শোভা করে সেই ভাবেই ফুলী কাঁথাখানি তৈরী করিয়াছে। আর সবগুলি নকসই বাঙালীর যুগ যুগান্তরের রস-সৃষ্টির সঙ্গে যোগ–সংযোগ করিয়া হাসিতেছে। বছির অনেক বড় বড় কেতাবে সূচিকার্য রূপান্তরিত রাফেলের ভুবন বিখ্যাত ছবিগুলির প্রতিচ্ছবি দেখিয়াছে। এখানে যাহারা সূচিকার্য করিয়াছে তাহারা বহু বৎসর সুদক্ষ শিক্ষকের অধীনে থাকিয়া শিক্ষালাভ করিয়াছে। তাহাদের শিল্প কার্যে নিজস্ব কোন দান নাই। রাফেল যেমনটি আঁকিয়াছেন তাহারই অনুকৃতি করিয়াছে। কিন্তু এই অশিক্ষিতা পল্লী বালিকার নকসায় যে অপটু হাতের ভুলত্রুটি রহিয়াছে তাহারই গবাক্ষ পথ দিয়া মনকে শিল্পীর সৃজিত রসলোকে লইয়া যায়। সৃষ্টিকার্য মেয়েটি করিয়াছে শুধুমাত্র তাহারই জন্য। কতদিনের কত সুদীর্ঘ সকাল দুপুরে সূক্ষ শুই ধরিয়া একখানা মূক-কাপড়ের উপর সে তাহার অনুরাগের রঙ মাখাইয়া দিয়াছে। জীবনে বহু ভাগ্যের অধিকারী না হইলে এই। অপূর্ব দানের উপযুক্ত হওয়া যায় না। তবু এই দানকে তাহার প্রত্যাখান করিতে হইবে। এই সরলা পল্লী-বালিকার মনে তাহার প্রতি যে অনুরাগের রঙ লাগিয়াছে তাহা নিষ্ঠুর হাতে মুছিয়া যাইতে হইবে। নতুবা পরবর্তী জীবনে এই ভোরের কুসুমটি যে দুঃখের অগ্নিদাহনে জ্বলিবে, তাহার হাত হইতে কেহই তাহাকে নিস্তার করিতে পারিবে না।
ফুলী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল,”বছির বাই! আমার কাঁথাখানা কেমন ঐছে কইলা না ত?”
বছির বলিল, “মন্দ হয় নাই। এখানা তুমি যত্তন কইরা রাইখ। একদিন কামে দিবি।”
এ কথা শুনিয়া ফুলীর মনটা কেমন করিয়া উঠিল। সে আশা করিয়াছিল বছির তাহার এত যত্নে তৈরী করা কথাখানা পাইয়া কতই না উচ্ছ্বসিত হইয়া তাহা গ্রহণ করিবে। সেবার একখানা রুমালের উপর মাত্র একটা ফুল তুলিয়া ফুলী তাহাকে দিয়াছিল। তাই পাইয়া বছিরের কত আনন্দ। সে শহরে যাইয়াও বন্ধু-বান্ধবদের তাহা দেখাইয়া বলিয়াছে, আমার বোন এই ফুলটি করিয়া দিয়াছে। সেই খবর আবার বছির বাড়ি আসিয়া তাহাকে শুনাইয়াছে। কিন্তু এতদিন ভরিয়া যে কথাখানা সে এত সুন্দর করিয়া তৈরী করিয়াছে, যাহা দেখিয়া পাড়ার সকলেই তাহাকে কত প্রশংসা করিয়াছে–সেই কথাখানা দেখিয়া বছির ভাই কিনা বলিল–মন্দ হয় নাই।
ম্লান হাসিয়া ফুলী বলিল, “আমি কেন তোমার কথাখানা যত্তন কইরা রাখতি যাব? তোমার জন্যি বানাইছি। তোমার যদি মনে দরে যা খুশী তাই কর এটা নিয়া।” বলিতে। বলিতে ফুলী প্রায় কাঁদিয়া ফেলিল।
কিন্তু বছিরকে আজ নিষ্ঠুর হইতেই হইবে। কিছুতেই সে তার মনের দৃঢ়তা হারাইবে না।
সে বলিল, “আমি ত কয়দিন পরে বিলাত চইলা যাব। তোমার কথা দিয়া করব কি? সে দ্যাশের লোক এটা দেখলি হাসপি ঠাট্টা করবি।”
ম্লান মুখে ফুলী কাঁথাখানা গোটাইয়া ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়াইল। বছিরের মা বলিল, “ও ফুলী! এহনই আইলি আর চইলা গেলি। আয়-আয় হুইনা যা।” ফুলী ফিরিয়াও চাহিল না।
ফুলীর চলিয়া-যাওয়া পথের দিকে বছির চাহিয়া রহিল। তাহার প্রতিটি পদাঘাতে সে যেন বছিরের মনে কোন অসহনীয় বিষাদের কাহিনী লিখিতে লিখিতে তাহার দৃষ্টির আড়ালে চলিয়া গেল। কিন্তু ইহা ছাড়া বছির আর কিইবা করিতে পারিত। তবু ফুলীর সুন্দর মুখোনি কে যেন রঙিন তুলি দিয়া তার মনের পটে আঁকিয়া দেয়। সেই ছবি সে জোর করিয়া মুছিয়া ফেলে কিন্তু আরও উজ্জ্বল হইয়া–আরও জীবন্ত হইয়া সেই ছবি আবার তাহার মনের-পটে আঁকিয়া ওঠে। এ যেন কোন চিত্রকর জোর করিয়া তাহার মনের-পটে নানা চিত্র আঁকিতেছে। তাহাকে থামাইতে গেলেও থামে না।