বছির উত্তর করিল, “আমি ত ম্যালোয়ারী জ্বরের উপর গবেষণা করতিই বিলাত যাইতাছি। আপনারা দোয়া করবেন, আমি যেন সগল কাম হাছিল কইরা আসতি পারি। দ্যাশে আইসা অনেক কাম করতি হবি। এই গিরামে একটা ইস্কুল অবি। একটা হাসপাতাল অবি। আর অবি একটা কৃষি বিদ্যালয়। আরো অনেক কিছু করতি অবি। তার। আগে আমার বড় ঐতি অবি। অনেক টাহা উপার্জন কইরা তবে এই সব কামে হাত দিতি। অবি।”
গরীবুল্লা মাতবর বলিল, “বাবা বছির! আমরা সগলে দোয়া করি তোমার মনের ইচ্ছা যেন হাসেল হয়।”
গ্রামের সকলে একে একে বিদায় হইয়া চলিয়া গেল। হুঁকো টানিতে টানিতে আজাহের ছেলেকে বলিল, “বাজান! আর কয়দিন পরে তোমার বিলাত যাইতি অবি?”
বছির উত্তর করিল, “আরও পনর দিন পরে আমাকে রওয়ানা ঐতি অবি।”
“বাজান! একটা কতা আমাগো মনের মদ্দি অনেকদিন দইরা আনাগোনা করতাছে। আইজ তোমারে কইবার চাই। মাতবরের ম্যায়া ফুলীরে ত তুমি জানই। আমাগো দুইজনের ইচ্ছা, ফুলীরে বউ কইরা গরে আনি। মাতবরেরও মনে বড় আশা।”
বছিরের মা সামনে বসিয়া বসিয়া সুতলী পাকাইতেছিল। সে কান পাতিয়া রহিল বছির কি উত্তর করে।
বছির বলিল, “বাজান! আমার জীবনডারে আগে গইড়া নিতি দ্যান। এহন আমি কাটার উপর দিয়া পথ চলতাছি। আপনারা জানেন না এই লেহাপড়া শিখতি আমারে কত দুস্কু কষ্ট সইতি ঐছে। আইজ আমার কাছে বিয়া করার কথা একটা হাসি-তামাসার মত মনে হয়।”
বছিরের মা বলিল, “বাবা বছির! তুই না করিস না। ফুলুরে গরে আইনা আমি .. আমার বড়র শোগ পাশরি। বড়র বড় আদরের সাথী ছিল ফুলু।”
বছির নত হইয়া উত্তর করিল, “মা! আমি যাইত্যাছি সাত সমুদ্র তের নদীর উপারে। বাজান যা কামাই করে তাতে তোমাগো দুইজনের খাওনই জোটে না। এর উপর আমার একটা বউ আইলে তারে তোমরা কেমন কইরা খাওন দিবা?”
আজাহের বলিল, “আমাগো কি খাওন দিবার শক্তি আছেরে বাজান? খাওন আল্লায় দিব।”
বছির উত্তর করিল, “না বাজান! আল্লায় খাওন দেয় না। মানুষের খাওন মানুষের জোগাড় কইরা নিতি অয়। তোমাগো পায়ে ধরি, তোমরা আর আমারে এ সগল কথা কইও না।”
আজাহের বুঝিল ছেলের এখন বিবাহ করিবার ইচ্ছা নাই। ছেলে লেখাপড়া শিখিয়াছে। বই পুস্তক পড়িয়া তার অনেক বুদ্ধি হইয়াছে। সে যাহা বুঝিয়াছে হয়ত তাহাই তাহার পক্ষে ভাল। তাই বউকে বলিল, “বছিরের মা! তুমি ওরে আর পীড়াপীড়ি কইর না। ও লেহাপড়া শিখ্যা মানুষ হয়া আসুক। তখন ওর বউ ও নিজেই বাইছা নিতি পারবি।”
রাত অনেক হইয়াছে। বছির শুইয়া পড়িল। মা বছিরের পাশে শুইয়া পাখার বাতাস করিতে লাগিল। ছেলে আর মাত্র পনরটা দিন তাহার কাছে থাকিবে। তারপর চলিয়া যাইবে সেই কত দূরের দেশে। সেখান হইতে কবে ফিরিতে পারিবে কে জানে? ছেলের ফেরার আগে যদি মায়ের মরণ হয়, তবে ত মরিবার আগে ছেলের মুখ দেখিতে পাইবে না! তবুও যাক–ওর জীবনের উদ্দেশ্য সফল করিয়া দেশে ফিরিয়া আসুক। ছেলেকে বাতাস করিতে করিতে মায়ের কত কথাই মনে পড়ে। ও যখন এতটুকু ছিল। শেষ রাত্রে জাগিয়া উঠিয়া খেলা করিত। তারা স্বামী স্ত্রী দুইজন ছেলের দুই পাশে বসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত। ভাঙা ঘরের ফাঁক দিয়া চাঁদের আলো আসিয়া ছেলের মুখে পড়িত। ভাবিতে ভাবিতে মা স্বপ্ন দেখে বছির যেন আবার এতটুক হইয়া গিয়াছে। পাঠশালা হইতে ফিরিয়া আসিয়াই তাহার ঘরের মেঝেয় বসিয়া পিঠা খাইতেছে। তারপর সে বড় হইয়া শহরে গেল লেহাপড়া করিতে। কে যেন যাদুকর বছিরের বিগত জীবনের সমস্ত কাহিনী পুতুল নাচের ছবিতে ধরিয়া মায়ের চোখের সামনে মেলিয়া ধরিয়াছে।
পরদিন সকালে ভোরের পাখির কলকাকলীতে বছিরের ঘুম ভাঙিয়া গেল। উঠিয়া মুখ হাত ধুইয়া বেড়াইতে বাহির হইবে এমন সময় ফুলী আসিয়া উপস্থিত। এতদিন সে ফুলীর চেহারার দিকে লক্ষ্য করে নাই। তার মৃত বোন বড়ুরই প্রতীক হইয়া সে তাহার মনের স্নেহধারায় সিঞ্চিত হইত। তাহা ছাড়া নানা অভাব-অভিযোগ, দৈন্য-অবহেলার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াই তাহার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়া গিয়াছে। কোন মেয়েকে সুন্দর বলিয়া দেখিবার সময় তাহার কখনো হয় নাই। সেই ছোটবেলা হইতে ফুলীকে যেমনটি দেখিত, তাহার মনে হইত সে যেন তেমনটিই রহিয়াছে। কাল পিতার নিকট ফুলীর সঙ্গে তাহার বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখান করিয়া আজ ফুলীকে সে নতুন দৃষ্টি লইয়া দেখিল।
মরি! মরি! কি লাবণ্যই না ফুলীর সারা দেহে ফুটিয়া উঠিয়াছে। কে যেন দীঘির কলমী ফুলটি আনিয়া তাহার সুন্দর হাসিভরা মুখে ভরিয়া দিয়াছে। হলুদে আর লালে মেশান অল্প দামের শাড়ীখানা সে পরিয়া আসিয়াছে। সেই শাড়ীর আড়াল হইতে তার হলুদ রঙের বাহু দুইখানা যেন আকর্ষণের যুগল দুইখানা ধনু তাহার দিকে উদ্যত হইয়া রহিয়াছে। মুগ্ধ হইয়া বছির অনেকক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। এই চাঁদ হয়ত আকাশ ছাড়িয়া আজ তাহার আঙিনায় আসিয়া খেলা করিতেছে। হাত বাড়াইলেই তাহাকে ধরা যায়; তাহাকে বুকের অন্ধকার ঘরের প্রদীপ করা যায়; কিন্তু বিলম্ব করিলে এই চাঁদ যখন আকাশে চলিয়া যাইবে, তখন শত ডাকিলেও আর ফিরিয়া আসিবে না। কিন্তু বছির এ কি ভাবিতেছে! তার জীবনের সম্মুখে যে সুদীর্ঘ পথ এখনও পড়িয়া রহিয়াছে। সে পথে কত বিপদ, কত অভাব-অনটন, তার গতিধারা সে ত এখনও জানে না। সে জীবন পথের যোদ্ধা। সংগ্রাম শেষ না হইলে ত তাহার বিশ্রাম লইবার ফুরসত হইবে না।