ফকির-মা তাহাকে আদর করিতে করিতে বলিল, “বাজানরে! আমার ফকির কইছে কোন কিছুতেই ভয় করতি নাই। মরণ যদিই বা আসে তারে গলার মালা কইরা নিবি। মরণ তো একদ্যাশ থইনে আর এক দ্যাশে যাওয়া। সে দ্যাশে হয়ত এমুন দুস্কু কষ্ট নাই। হয়ত সে দ্যাশে তোমার মায়ের চায়াও দরদী মা আছে–বন্ধুর চায়াও দরদী বন্ধু আছে। নতুন দ্যাশে যাইতি মানুষ কত আনন্দ করে। যদি সে দ্যাশে তোমার যাইতিই হয়, মুখ কালা কইরা যাইও না বাজান! খুশী মনে যাইও ।”
ফকির মায়ের হাতখানা আরও বুকের মধ্যে জড়াইয়া করিম বলিল, “ফকির-মা! তোমার কথা শুইনা বুকির মদ্দি বল পাইলাম। আমার মনে অনেক সাহস আইল।”
ফকির-মা বলিল, “বাজানরে! আমার ফকির যে আনন্দ ধামে বিরাজ করে। তাই যেহানে যাই, সেহানেই আমার ফকির আনন্দ আইনা দেয়। আমার ফকিরের দরবারে নিরাশা নাই বাজান!” এই বলিয়া ফকির-মা একটি গান ধরিল–
ধীরে ধীরে বাওরে নৌকা
আমারে নিও তোমার নায়।
পদ্মা নদীর তুফান দেইখ্যা
প্রাণ করে হায় হায়,
ও মাঝি শক্ত কইরা হাইল ধরিও
আজকা আমার ভাঙা নায়।
আমি অফর বেলায় নাও ভাসাইলাম
অকুল দরিয়ায়;
কূলের কলঙ্ক হবে
যদি তরী ডুইবা যায়।
তুফানের বানাইছি বাদাম
মেঘের বানছি ছয়া,
ঢেউ-এর বৈঠা বায়া মাঝি
আমারে যাও লয়া।
ডুবুক ডুবুক ভাঙা তরী
ডুবুক বহু দূর,
ডুইবা দেখব কোথায় আছে
ডবুনিয়ারপুর।
গান গাহিতে গাহিতে ফকির-মার দুইচোখ জলে ভাসিয়া যাইতে লাগিল। গান শেষ হইলে করিম বছিরকে কাছে ডাকিয়া বলিল, “বছিরবাই! তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা ছিল। সেদিন কইবার পারি নাই। আজ তোমারে কয়া যাই।”
আরও নিকটে আসিয়া বছির বলিল, “কও ত বাই! কি কথা?”
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া করিম বলিল, “বছিরবাই! আমার দিন ত ফুরায়াই আইছে। মা বাপের লগে আর দেখা অবি না। তারা যদি হোনে আমি পথে পইড়া মরছি সে শোগ তারা পাশরতি পারবি না। তুমি তাগো কাছে কইও, আমি হাসপাতালে যায় মরছি। অনেক বড় বড় ডাক্তার কবিরাজ আমার চিকিচ্ছা করছে। আমার কোরান শরীফখানা আমার মা জননীরে দিও। এই কেতাবের মদ্দি অনেক সান্ত্বনার কথা আছে। কাউরে দিয়া পড়ায়া মা যেন তা শোনে। তাতে সে আমার যোগ কতকটা পাশরতি পারবি।” এই বলিয়া করিম হাঁপাইতে লাগিল।
বছির করিমের মুখে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “ভাই করিম! তুমি অত কথা কইও না। দেখছাও না তুমি কেমন হাঁপায়া উঠছাও। একটু চুপ কইরা থাহ।”
করিম বলিল, “না বাই! আমারে চুপ করতি কইও না। আমার বেশী সময় নাই! আর একটা মাত্র কথা। আমার ঝুলির মদ্দি একগাছা রাঙা সূতা আছে। আমার ছোট বোনটিরে নিয়া দিও। তারে কইও, তার গরীব ভাইজানের ইয়ার চাইতে বাল কিছু দিবার শক্তি ছিল না।” বলিতে বলিতে করিমের কাশি উঠিল। সেই কাশিতে তার বুকখানা যেন ফাটিয়া যাইবে । তারপর আস্তে আস্তে সে চিরনিদ্রায় ঘুমাইয়া পড়িল। তার মুখখানা কাপড় দিয়া ঢাকিয়া ফকির-মা আবার গান ধরিল–
চল যাইরে,
আমার দরদীর তালাশেরে
মন চল যাইরে।
.
৩৯.
দিনে দিনে হায়রে ভাল দিন চইলা যায়। বিহানের শিশির ধারা দুপুরে শুখায়। বারো জঙ্গ করে মদ্দ কিতাবে খবর, তের জঙ্গ লেখা যায়রে টঙ্গির শহর। জেলা স্কুল হইতে পাশ করিয়া বছির ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ হইতে জলপানি পাইয়া আই, এস, সি, পাশ করিয়া বিলাত চলিল জীবাণু বিদ্যার উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করিতে। এত পথ সে কি করিয়া পার হইবে? কোন-জাহাজের খালাসী হইয়া যাইবে। বিলাতে যাইয়া সে প্রথমে সিলেটিদের হোটেলে কাজ করিবে? তারপর সুযোগ মত পড়াশুনা করিবে।
তার জীবনের সুদীর্ঘ কাহিনীর সঙ্গে কতক তার নিজের অক্লান্ত তপস্যা, কতক তার অভাব অনটনকে জয় করার অপরিসীম ক্ষমতা মিশিয়া রহিয়াছে। তাহার সঙ্গে আরও রহিয়াছে তাহার অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের শুভকামনা। তাই তাহার এই সাফল্যে সমস্ত গ্রাম গৌরবান্বিত।
রাত্রে গ্রামের সকল লোক আসিয়া জড় হইল তাহাদের উঠানে। গরীবুল্লা মাতবর, তাহের লেংড়া, মাকিম, তমু সকলের আগে আসিল।
গরীবুল্লা মাতবর বলিল, “তা বাবা বছির! তুমি আমাগো গিরামের নামডা আসমানে। উঠাইলা। বিদ্যাশে বিভূঁইয়ে চলছাও। আমাগো কথা মনে রাইখ।”
বছির উত্তর করিল, “চাচা! আমার জীবনের যত সুখ্যাতি তার পিছে রইছে আপনাগো দোয়া আর সাহায্য। আপনারা যদি আমারে সাহায্য না করতেন তয় আমি এতদূর যাইতি পারতাম না। ফইরাতপুরির ইস্কুলে পড়নের সময় যহন বাজান গামছায় বাইন্দা পাটালী গুড় নিয়া গ্যাছে আর আমারে কইছে, মাতবরের বউ দিছে তোরে খাইবার জন্যি; তহন আমার মনে যে কত কথার উদয় হইতে তা আপনাগো বুজাবার পারব না। গিরামের সবাই আমারে কিছু না কিছু সাহায্য করছে। আপনারা সগলে চান্দা তুইলা আমার পড়ার খরচ দিছেন। আপনাগো উপকারের পরিশোধ আমি কুনুদিন দিতি পারব না।”
গরীবুল্লা মাতবর বলিল, “বাজান! তোমার কুনু পরিশোধ দিতি অবি না। তুমি সগল। বিদ্যা শিখা বড় হয়া আইস, তাতেই আমাগো পরিশোধ হবি।”
আজাহের আওগাইয়া আসিয়া বলিল, “ওসব পরিশোধের কথা আমি বুজি না। আমাগো গিরামের লোক অর্ধেক হয়া গ্যাল ম্যালোয়ারী জ্বরে। তুই বিলাত গুণা ম্যালোয়ারী জ্বরের ওষুধ শিহা আসতি পারবি কিনা তাই সগলরে ক? এমুন দাওয়াই শিহা আসপি যা খাইলি কাউরও ম্যালোয়ারী অবি না।”