এবার কনের বাপ আসিয়া বলিল, “রাহেন মাতব্বরসাবরা, আপনারা কেউ কারো চাইতে কম না। এ তো আমরা সগলেই জানি। এবার বিয়ার জোগাড় কইরা দেন। হগল মানুষ বইসা আছে।” এ কথায় দুই মাতব্বরই খুশী হইল।
তখন সাক্ষী, উকিল, বাড়ীর ভিতরে যেখানে নতুন শাড়ী পরিয়া পুটলীর মত জড়সড় হইয়া দুই একজন সমবয়য়ী পরিবৃতা হইয়া বিবাহের কনে বসিয়া ছিল, সেখানে যাইয়া উপস্থিত হইল। উকিল জোরে জোরে বলিতে লাগিল,
“আলীপুর গ্রামের বছিরদ্দী মিঞার ছেলে আজাহের মিঞার সঙ্গে তোমার বিবাহ হইবে। দুইশত টাকা দেনমোহর, পঁচিশ টাকা আদায়, একশত পঁচাত্তর টাকা বাকী। এই শর্তে কবুল ত?”
কনে লজ্জায় আর কোন কথাই বলিতে পারে না। একজন বর্ষিয়সী মহিলা কনের মাথায় হাত দিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “হ, কনে কবুল আছে।” এইভাবে তিনবার জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর লওয়া শেষ হইলে সাক্ষী উকিলেরা বিবাহ সভায় যাইয়া বলিল, “বিয়ায় বিবি রাজি আছেন।”
তখন বচন মোল্লা বিবাহ পড়াইতে বসিলেন। প্রথমে কোরান শরিফ হইতে খানিকটা পড়িয়া মোল্লা সাহেব পূর্বের মত বলিতে লাগিলেন, “ভাটপাড়া গাঁয়ের আলিমদী মিঞার কন্যা আয়েসা বিবির সঙ্গে আপনার বিবাহ হইবে। দুইশত টাকা দেনমোহর, পঁচিশ টাকা আদায়, একশত পঁচাত্তর টাকা বাকী। এই শর্তে কবুল ত?” আজাহের লজ্জায় যেন মাটিতে লুটাইয়া পড়ে তবু বলে, “কবুল”।
এইভাবে তিনবার মোল্লা তাহাকে উপরোক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনবার সে বলিল, “কবুল”। মোল্লা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিবি যখন তখন বাপের বাড়ীতে আসতি পারবি, তারে কুনু কারণে মাইর ধইর করতি পারবা না। তারে তুমি সাধ্যমত রোজা নামাজ শিখাইবা। তার ইজ্জত-হুঁরমত রক্ষা করবা। তোমার সঙ্গে বিবির যদি কোন কারণে বনিবনাও না অয়, হে আইসা বাপের বাড়ি থাকপি। তুমি তার খোরপোষ দিবা। এই শর্তে কবুল ত?”
আজাহের বলিল, “কবুল”।
মোল্লা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি যদি বিদেশে সফরে যাও তবে রীতিমত বিবিকে খোরপোষ পাঠাইবা, সপ্তাহে একবার পত্র দিবা। যদি ছয়মাস একসঙ্গে বিবির তালাস না লও তবে ইচ্ছা করলি বিবি তোমার কাছ ঐতে তালাকনামা লইতি পারবি। এই সত্য কবুল?”
আজাহের বলিল, “কবুল”।
তখন মোল্লা কোরান শরিফ হইতে আর একটি আয়েত পড়িয়া মোনাজাত করিলেন। বিবাহের পান-শরবত আগেই আনা হইয়াছিল। বিবাহ পড়াইয়া মোল্লা আজহেরকে পান-শরবত খাওয়াইয়া দিলেন। এইভাবে রাত্রি ভোর হইয়া গেল। কাছারী ঘরে গাঁয়ের লোকেরা সারাদিন গুলজার করিয়া কেতাব পড়িতে লাগিল, কেহ গল্প-গুজব করিতে লাগিল।
বিকাল বেলা আজাহেরকে বাড়ির ভিতর লইয়া যাওয়া হইল। নতুন দুলার (বরের) সঙ্গে কনের ক্ষীর-ভোজনী হইল। প্রথমে উঠানে কনেকে আনিয়া একখানা পিড়ির উপর। দাঁড় করান হইল। এয়োদের নির্দেশ অনুসারে আজাহের কনের সামনে আর একখানা পিড়ির উপর দাঁড়াইল। কনে আর বরের মাঝখানে একখানা চাদর টানান, সেই চাঁদরের দুই কানি ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে দুইটি কিশোরী মেয়ে। চাঁদরের সামনে দাঁড়াইয়া আজাহেরের বুক কপিতে লাগিল। কি জানি কেমন যেন তাহার লাগিতেছিল। এই কাপড়ের আড়ালে তাহার কনে রহিয়াছে! এই বউ তাহার সুন্দর হইবে কি কুৎসিত হইবে সে ভাবনা আজাহেরের মোটেই ছিল না। কিন্তু কেন জানি তার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগিল। বাড়ির মেয়েরা কৌতূহলী দৃষ্টি লইয়া একটু দূরে দাঁড়াইয়াছিল।
আজাহেরের সঙ্গে মোড়লও বাড়ির ভিতরে গিয়াছিল। সাধারণতঃ এরূপ স্থানে বরের বোনের জামাই অথবা ইয়ার্কি ঠাট্টার সম্পর্ক জড়িত আত্মীয়েরাই বাড়ির ভিতরে যাইয়া থাকে। কিন্তু আজাহেরের কোন আত্মীয়-স্বজন নাই বলিয়াই মোড়ল তাহার সহিত বাড়ির মধ্যে আসিয়াছে। গ্রাম্য মুসলমান মেয়েরা পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলিতে পরদা প্রথার শাসন মানিয়া থাকে। কিন্তু বিবাহ ব্যাপারে তাহারা সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার অতটা অনুশাসন মানিয়া চলে না। তাহারা সকলেই কলরবে বলিয়া উঠিল, “টাহা না অইলে কনের মুখ দেহাব না।”
মোড়ল তখন তার কেঁচার খুঁট হইতে অতি সন্তর্পণে বাধা আট আনা পয়সা বাহির করিয়া মেয়েদের কাছে দিল। মেয়েরা তাহাতে রাজী হইবে না,–কিছুতেই না। মোড়লও বেশী দিতে চাহে না, আজাহেরের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙ্গিবার উপক্রম হইতেছিল। এমন শুভদৃষ্টির সময়ে মোড়ল কেন দরাদরি করে। এতগুলো মেয়ে তাহাকে কি মনে করিতেছে।
অবশেষে বার আনায় রফা হইল। বার আনা পয়সা পাইয়া মেয়েরা শা-নজর করাইতে রাজী হইল। মোড়ল আগেই আজাহেরকে শিখাইয়া দিয়াছিল, এই সব জায়গায় সহজে চোখ মেলিয়া চাহিবি না–লজ্জা লজ্জা ভাব দেখাইবি। কিন্তু কনের সামনের পরদা তুলিয়া দিতেই আজাহের মোড়লের সকল উপদেশ ভুলিয়া গেল। সে চোখ দুইটি সম্পূর্ণ মেলিয়া কনের দিকে একদৃষ্টিতে খানিক চাহিয়া রহিল। তারপর মনের খুশীতে একবার হাসিয়া উঠিল। আজাহেরের হাসি দেখিয়া সমবেত মেয়ের দল একবারে হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। আজাহের ভাবিয়া পাইল না কেন তাহারা এত হাসে।
এবার ঘরের মধ্যে যাইয়া কনের সঙ্গে ক্ষীর-ভোজনী হইবে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে আজাহের তাহার কনে-বউকে কোল-পাথালী করিয়া কোলে তুলিয়া ঘরে লইয়া গেল। বউকে মাটিতে নামাইয়া দেওয়ার পরে বহুক্ষণ তাহার কোমল গায়ের উষ্ণতা আজাহেরের সমস্ত দেহে ঢেউ খেলিতে লাগিল।