মোড়ল এমনই করিয়া সকলের আগে যাইয়া দাঁড়াইল; দেখিয়া আজাহেরের মন মোড়লের প্রতি শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে একেবারে ভরিয়া গেল। আজীবন তার বাড়িতে বিনা। বেতনে খাঁটিলেও বুঝি ইহার শোধ হইবে না।
মোড়ল সকলের আগে যাইয়া বলিল, “বুলি, তুমরা দারোয়ানী দরছাও ক্যান?”
ছেলেরা সমস্বরে উত্তর করিল, “বিবির হুকুম আছে, কেউরে দরজার মদ্দি যাইতে দিব । তবে যদি বাদশা আমাগো কিছু বকশিশ দ্যান তয় আমরা যাইতে দিতি পারি!”
মোড়ল বলিল, “কত বকশিশ চাও?”
তারা উত্তর করিল, “দশ টাহা।”
মোড়ল উত্তর করিল, “আরে বাপুরা ছাইড়া দাও। গরীব মানুষির বিয়া, কিছু কমটম কর।”
“আচ্ছা তয় পাঁচ টাহা।”
“আরে না, অত দিবার পারবনা।”
“তবে এক টাকা দেন।”
“আরো কম কর।”
“তবে আট আনা।”
“আরে গরীব মানষির বিয়া, আরো কিছু কমাও। মোটে চাইর আনা দিমু।”
ছেলের দল তাহাতেই খুশী হইয়া দরজা ছাড়িয়া দিল। আজাহেরের কিন্তু ভাল লাগিল না। কথায় বলে,–বিবাহের দিনে সকলেই আড়াই দিনের বাদশাই করে। আজ তার বাদশাইর দিন। না হয় মোড়ল আরো চার আনা ধরিয়া দিত। জন খাঁটিয়া ত খাইতে হয়ই। না হয় আজাহের আরো একদিন বেশী খাঁটিয়া সেই ঋণ পরিশোধ করিত। ছেলেদের কাছে। এতটা গরীব সাজা মোড়লের উচিত হয় নাই।
আজাহেরের শ্বশুরের নাম আলিমদ্দী। সে বড়ই গরীব। বাড়িতে কাছারী ঘর নাই। গোয়াল ঘরখানা পরিষ্কার করিয়া গোটা কতক খেজুর পাতার পাটি বিছাইয়া দেওয়া হইয়াছে। তাহাতেই বরযাত্রীর দলটিকে অতি আদরের সহিত আনিয়া বসান হইল। আজাহেরের বড়ই ভাল লাগিল। আজ বিবাহ বাড়ির সকলেরই দৃষ্টি তাহার দিকে। বরযাত্রীর দলের সবার চাইতে সে বেশী আদর পাইতেছে। খাইবার সময় তারই পাতে সব চাইতে ভাল ভাল জিনিসগুলি পড়িতেছে। গাঁয়ের মাত্র পাঁচজন লোক সে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে। সবাই যদি আসিত, আজ দেখিয়া যাইত, আজাহের একেবারে কেউকেটা নয়। তাকেও লোকে খাতির করে।
বরযাত্রীদের খাওয়া দাওয়া সারা হইল। এবার বিবাহ পড়ানোর পালা। ভাটপাড়া গ্রামের বচন মোল্লাকে ডাকিয়া আনা হইয়াছে বিবাহ পড়াইতে। সাক্ষী উকিল ঠিক করিয়া বাড়ির ভিতর পাঠান হইল। উকিল যাইয়া জিজ্ঞাসা করিবে কনের কাছে, “অমুক গ্রামের অমুকের ছেলে অমুক, তার সঙ্গে তোমার বিবাহ হইবে। দুইশত টাকা দেনমোহর, পঁচিশ টাকা আদায়–একশত পঁচাত্তর টাকা বাকি; এই শর্তে কবুল ত?” তিনবার এইভাবে কনেকে জিজ্ঞাসা করা হইবে। উহার উত্তরে কনে কি বলে তাহা জানিয়া দুইজন সাক্ষী বিবাহ সভায় সকলকে তাহা জানাইয়া দিবে। কিন্তু সাক্ষী উকিলেরা মজা করিবার জন্য বাড়ির মধ্যে কনের কাছে না যাইয়া বাহির হইতে একটু ঘুরিয়া বিবাহ সভায় আসিয়া বলিল, “কনে এই বিবাহে রাজি অয় নাই।”
বচন মোল্লা হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন রাজি অয় নাই।”
“কনের একটি কতা জিগাইবার আছে।”
“কি কতা জিগাইবার আছে?”
“বচ্ছরকে দুইটা পাখি আসে। তার একটা সাদা আর একটা কালা। আপনারা কালাডা খাইবেন না ধলাডা খাইবেন। কোনভা আপনাগো জন্যি আনবো?”
শুনিয়া আজাহেরের মাথা ঘুরিয়া গেল। সে গরীব মানুষ, কারো বিবাহে কোন দিন যায়। নাই–গেলে সহজেই বুঝিতে পারিত এমনই প্রশ্নের বাদ-প্রতিবাদ প্রত্যেক বিবাহেই হইয়া থাকে। আজাহের ভাবিল এইবারই বুঝি তার বিবাহ ভাঙ্গিয়া গেল। এই প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারিবে না, বিবাহও হইবে না। মোড়ল কিন্তু একটুও দমিল না। সে সামনে আগাইয়া আসিয়া একটু হাসিয়া উত্তর করিল, “মিঞারা, বুঝতি পারলাম ঠকাইবার চাও। বচ্ছরকে দুইডা পাখি আসে রোজার মাসে, কালা পাখি ঐল রাইত আর ধলা পাখি ঐল দিন। তা আমি কালা পাখিই খাইলাম। রোজার মাসে ত কালা রাত্তিরেই ভাত খাইতে হয়।”
“পারছেরে, পারছে” বলিয়া কনে পক্ষের লোকেরা হাসিয়া উঠিল। এইবার মোড়ল গায়ের চাদরখানা মাজার সঙ্গে জড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা মিঞারা! আপনাগো কতার জবাব আপনারা পাইলেন। এইবার আমি একটা কতা জিজ্ঞাস কইরা দেহি :
“মাইটা হাতুন কাঠের গাই–
বছর বছর দুয়ায়া খাই।”
কওত মিঞারা ইয়ার মানে কি?”
কনে পক্ষের সাক্ষী উকিলদের মাথা ঘুরিয়া গেল। বর পক্ষের মাতব্বর যে এমন পাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া বসিবে ইহা তাহারা ভাবিতেই পারে নাই।
তাহাদিগকে মুখ কাচুমাচু করিতে দেখিয়া বর পক্ষের লোকদের মুখে ঈষৎ বাঁকা হাসি ফুটিয়া উঠিল।
কনে পক্ষের মোড়ল বরান খ তখন উঠিয়া দাঁড়াইল চীৎকার করিয়া উঠিল –”আরে খার বিটা! পুলাপানের কাছে ওসব কথা জিজ্ঞাসা করেন ক্যান? আমার কাছে আসেন।
মাইটা হাতুন কাঠের গাই,
বছর বছর দুয়ায়া খাই।
মানে খেজুর গাছ। এক বছর পরে খাজুইর গাছ কাটা হয়। মাটির হাঁড়ী গাছের আগায় বাইন্দা রস ধরা হয়, কি মাতব্বর সাব! ওইল? সেই জন্য কইছে বছর বছর দুয়ায়া খাই। আচ্ছা এইবার আমি একটা কতা জিজ্ঞাসা করি,–
নয় মন গোদা, নয় মন গুদি,
নয় মন তার ছাওয়াল দুটি।
নদী পার অইব। কিন্তুক নৌকায় নয় মনের বেশী মাল ধরে না। কেমন কইরা পার অবি? কন ত দেহি সোনার চানরা।”
মোড়ল এবার লাফাইয়া উঠিয়া বলিল,–”তবে শোনেন, পেরতমে দুই ছাওয়াল পার হ’য়া ওপারে যাবি। এক ছাওয়াল ওপারে থাকপি, আর এক ছাওয়াল নাও বায়া এপারে আসপি। তারপর গোদা নৌকা বায়া ওপারে যাবি। গোদার যে ছাওয়াল ওপারে রইছে সে নৌকা বায়া এপারে আসপি। আইসা দুই ভাই আবার ওপারে যাবি। ওপার ত্যা এক ভাই নৌকা লয়া এপারে আসপি। এবার গোদার বউ নৌকা লয়া যাবি। ছাওয়ালডা এপারেই থাকপি। ওপার যে ছাওয়ালডা রইছে সে নৌকা নিয়া আইসা এপার ত্যা তার বাইরে লয়া যাবি। ওইল ত? আচ্ছা, আমি জিজ্ঞাসা করি আবার।”