.
০২.
সত্য সত্যই আজাহেরের বিবাহ স্থির হইয়া গেল। বউঘাটা ছাড়িয়া গাছবাইড়ার চক। তাহারই দক্ষিণে ভাটপাড়া গ্রামে আলিমদ্দীর মেয়ের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইবে। গ্রামের মোড়ল তিনকুড়ি টাকাতেই বিবাহের খরচ সারিয়া দিবে। কিন্তু তিনকুড়ি টাকাতেই বিবাহের সমস্ত খরচ কুলাইয়া উঠিল না। আলিপুর গ্রামের শরৎ সাহার বাড়ি হইতে আজাহেরকে আরো পনর টাকা কর্জ করিতে হইল। টাকা প্রতি মাসে মাত্র এক আনা করিয়া সুদ দিতে হইবে। তা হোক; শরীর যদি ভালো থাকে আজাহের পৈড়াত বেচিয়া দুই মাসের মধ্যেই। দেনাটা শোধ করিয়া দিবে।
গরীবের বিবাহ–তবু গরীবানা মতে তাহারই মধ্যে যতটা আনন্দ করা যায় কেউ সে। বিষয়ে কম করিল না। মেনাজদ্দী মাতব্বরের উৎসাহই এ বিষয়ে সকলের চাইতে বেশী। সে ফরিদপুরের খলিফাপট্টী হইতে তাহার জন্য লাল ফোঁটা দেওয়া একটি পিরান (জামা)। কিনিয়া আনিল। নিজের যে চাদরখানা একদিন তেলে ও ঘামে সিক্ত হইয়া নানা দরবারের সাক্ষ্য হইয়া তাহার কাঁধের উপর ঘুরিয়া বিরাজ করিত, তাহা সে আজ বেশ সুন্দর করিয়া পাকাইয়া পাগড়ীর মত করিয়া আজাহেরের মাথায় পরাইয়া দিল। একজোড়া বার্নিশ জুতাও। মোড়ল আজাহেরের জন্য সংগ্রহ করিল। এ সব পরিয়া নতুন “নওশা” সাজিয়া আজাহের বিবাহ করিতে রওয়ানা হইল। তখন তাহার ইচ্ছা হইল এই নতুন পোশাকে সে একবার। সমস্ত গ্রামখানি ঘুরিয়া আসে। গাঁয়ের লোকদের সে অবাক করিয়া দিয়া আসে। সবার। বাড়িতে যে এতদিন পৈড়াত বেচিয়া আসিয়াছে, সে অতটা তুচ্ছ নয়। কিন্তু তখন রাত অনেকটা হইয়াছে। তাড়াতাড়ি যাইতে হইবে। বউঘাটা ছাড়াইয়া গাছবাইড়ার মাঠ পারাইয়া। যাইতে হইবে, সে ত সোজা কথা নয়।
অন্ধকারের মধ্যে গা ঢাকা দিয়া পাঁচ ছয়জন গাঁয়ের লোক বর লইয়া রওয়ানা হইল। যেমন ভাবে গাঁয়ের আরো দশজন বিবাহে রওয়ানা হয় আজাহেরের বিবাহে তেমন জাঁকজমক কিছুই ছিল না। গাঁয়ের বর্ধিষ্ণু পরিবারের ছেলেরা নতুন নওশার সাজ পরিয়া পাল্কিতে অথবা ঘোড়ায় চড়িয়া কনের বাড়িতে যায়। মশালচি আগে আগে মশাল জ্বালাইয়া পথ রোশনাই করে। গ্রামের মালাকর বরের জন্য শোলা দিয়া সুন্দর কারুকার্য খচিত একটি ছাতা তৈয়ার করিয়া দেয়। সেই ছাতা বরের মাথায় মেলিলে সুন্দর সুন্দর শোলার পাখি, নৌকা, ভ্রমর, প্রজাপতিগুলি বাতাসে দুলিতে থাকে। আজাহেরের বিবাহে এত সব : বন্দোবস্ত কিছুই হয় নাই। তবু আজাহেরের মন আজ খুশীতে যেন আসমানে উড়িয়া। বেড়াইতে চাহে। নিজের মনের খুশী দিয়াই সে তার বিবাহের সকল দৈন্য ভরাইয়া লইবে।
নওশার দল রওয়ানা হইল। নিস্তদ্ধ গ্রাম্য-পথ। দু’ধারে ঝি ঝি পোকা ডাকিতেছে। গ্রামের কুকুরগুলি ঘেউঘেউ করিয়া তাহাদের অভ্যর্থনা জানাইতেছে। দূরের বন হইতে শিয়ালগুলি ডাকিয়া উঠিতেছে। নওশার দল ধীরে ধীরে চলিয়া যায়। গ্রামের পর গ্রাম ছাড়াইয়া যায়।
বউঘাটা পার হইয়া তাহারা গাছবাইড়ার মাঠে আসিয়া পড়িল। সদ্য কেনা বার্নিশ জুতাজোড়া পায়ে লাগাইয়া চলিতে আজাহেরের পা ছুলিয়া যাইতেছিল। তবু সে জুতাজোড়া খুলিল না। এমনি নওশার সাজে, এমনই জুতা-জামা পরিয়া সে তাহার কনের বাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইবে। তাহার সমস্ত অন্তর ভরিয়া খুশীর ঋঝর যেন আজ বাজিয়া ঝুম ঝুম করিয়া আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া পড়িতেছে।
যাইতে যাইতে তাহারা কনের বাড়ির কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন বরযাত্রীর দল সকলে একস্থানে দাঁড়াইল। সবাই ভালমত করিয়া কাপড়-চোপড় পরিতে লাগিল। দশ বার বৎসর আগে মোড়ল সেই কবে এক জোড়া জুতা কিনিয়া রাখিয়াছিল–সে কথা আজ। ভাল করিয়া মনেও পড়ে না,–কিন্তু জুতাজোড়ার রঙ সেই প্রথম কেনার দিনের মত। আজো চকচক করিতেছে। এতদিনে রৌদ্রে জুতাজোড়া খড়ির মত শুখাইয়া কোচকাইয়া গিয়াছে। এমনই কোন বিশেষ দিনে কিংবা কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাইতে মোড়ল অল্প কয়েক মিনিটের জন্য সেই জুতাজোড়া পরিধান করিয়া থাকে। অর্থাৎ আত্মীয় বাড়ির। কাছে যাইয়া জুতাজোড়া পায়ে দেয় এবং সে বাড়িতে পৌঁছা মাত্রই জুতাজোড়া পা হইতে খুলিয়া ঘরের চালের সঙ্গে লটকাইয়া রাখে। ফেরার পথে জুতাজোড়া হাতে করিয়াই ফেরে। আজো মোড়ল জুতাজোড়া হাতে করিয়াই আনিয়াছিল। এখন বিবাহ-বাড়ির নিকটে আসিয়া জুতাজোড়া কাঁধের গামছা দিয়া মুছিয়া তাহার মধ্যে অবাধ্য পা দুটি ঢুকাইয়া দিল। এই কার্যটি করিতে বলিষ্ঠ-দেহ মোড়লকেও সেই জুতাজোড়ার সঙ্গে প্রায় পনর মিনিট যুদ্ধ করিতে হইল।
আজাহের তার রঙীন গামছাখানি অর্ধেকটা বুকপকেটে পুরিয়া দিল, বাকি অর্ধেক কাঁধের উপর ঝুলিতে লাগিল।
লোকে বলে,–”যেইনা বিয়া তার আবার চিতারি বাজনা।” কনের বাড়ির সামনের পথে গ্রামের ছেলেরা কলাগাছ পুঁতিয়া গেট বানাইয়াছে। সেই গেটের সামনে দারোয়ান হইয়া কলাপাতার টোপর মাথায় দিয়া কাঁধে গোড়ালী-লাঠি লইয়া তাহারা দাঁড়াইয়া আছে। তাহাদের দেখিয়া আজাহেরের গা কাঁপিতে লাগিল। মোড়ল কিন্তু কোনই ভয় করিল না। সে দলের আগে যাইয়া দাঁড়াইল। বরযাত্রীর দল আস্তে আস্তে বলাবলি করিল–”তোরা। কেউ কথা কবি না। যা কয় আমাগো মোড়ল কবি।”