রহিমদ্দী কারিকর তার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করে, “আরে কি মনে কইরা, আজাহের? বইস, বইস। তামুক খাও।”
ঘরের বেড়ার সঙ্গে লটকান কোটি লইয়া কলিকার উপরে ফুঁ দিয়া প্রথমে আজাহের কলিকার ছাইগুলি উড়াইয়া দেয়। তারপর কলিকার গুলটুকু ভাল জায়গায় ঢালিয়া রাখিয়া কলিকার মধ্যে খানিকটা তামাক ভরিয়া অতি সন্তর্পণে সেই গুলটুকু নিপুণ হস্তে তাহার উপর সাজাইয়া দেয়, যেন এতটুকুও নষ্ট না হইতে পারে। তাহার উপরে সুন্দর করিয়া আগুন ধরাইয়া রহিমদ্দী কারিকরের দিকে কোটি বাড়াইয়া ধরে।
কারিকর বলে–”আরে না, না, তুমি আগে টাইনা ধূমা বাইর কর।”
কারিকর যে তাকে এতটা খাতির করিয়াছে, আগে তাকে তামাক টানিতে বলিয়াছে এ যে কত বড় সম্মান! আজাহেরের সমস্ত অন্তর গলিয়া যায়। সে রহিমদ্দীর দিকে কোটি আরও বাড়াইয়া বলে, “কারিকরের পো, তা কি অয়? মুরব্বি মানুষ। তুমি আগে টাইনা দাও।”
খুশী হইয়া কারিকর হুঁকোটি হাতে লইয়া টানিতে আরম্ভ করে, তার তত চলা বন্ধ হয়। তামাক টানিতে টানিতে রহিমদ্দী জিজ্ঞাসা করে, “তা কি মনে কইরা আজাহের?”
যে কথা মনে করিয়া সে আসিয়াছিল লজ্জায় সে কথা আজাহের কিছুতেই বলিতে পারে না। অন্য কথা পাড়ে, “তা চাচা, একটা গীদ-টীদ গাও না শুনি? অনেক দিন গীদ শুনি না, তাই তুমার কাছে আইলাম।”
রহিমদ্দী খুশী হয়। তার গান শোনার জন্য ওই ও-পাড়া হইতে একজন এ-পাড়ায় আসিয়াছে, একি কম সম্মানের কথা! থাক না হয় আজ তাঁতের কাজ বন্ধ। রহিমদ্দী গান আরম্ভ করে। আমির সাধুর সারিন্দার গান। নদীর ঘাটে স্নানে যাইতে আমির সাধুর বউ বেলোয়া-সুন্দরীকে মগ জলদস্যুরা ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। পাগলের বেশে আমির সাধু তার সন্ধান করিয়া দেশে দেশে ফিরিতেছে। আমির সাধু সারিন্দা বানাইল–ছাইতানের কাঠ, নীলা ঘোড়ার বাগ। অপূর্ব সারিন্দা। নীলা ঘোড়ার বাগ বাকাইয়া সে সুর ধরিল?
“প্রথমে বাজিলরে সারিন্দা আমির সাধুর নামরে;
হারে তারিয়া নারে।”
আমির সাধু সেই সারিন্দা ভাঙ্গিয়া ফেলিল। আবার সে নতুন করিয়া সারিন্দা গড়িয়া তাহাতে সুর দিল ।
“তারপর বাজিলরে সারিন্দা–দেশের রাজার নামরে;
হারে তারিয়া নারে।”
তবু সেই সারিন্দা ও আমির সাধু ভাঙ্গিয়া ফেলিল। এবার আরো সুন্দর করিয়া অতি নিপুণ হস্তে ধনষ্টরী পাখির হাড় তাহাতে বসাইয়া, নীলা ঘোড়ার বাগ আরো বাঁকাইয়া সেই সারিন্দায় আবার সুর ধরিল। হেলিয়া দুলিয়া সারিন্দা বাজিয়া উঠিল,
“তারপর বাজিলরে সারিন্দা বেলোয়া সুন্দরীরে!
হারে তারিয়া নারে।”
এবার আমির সাধু খুশী হইল। সেই সারিন্দা বাজাইয়া আমির সাধু নদীর কিনারা দিয়া চলে। এ-দেশে সে-দেশে নানান দেশে সে ঘুরিয়া বেড়ায়। তার হাতের সারিন্দা গুমরিয়া গুমরিয়া কাঁদিয়া উঠে,–
“আজ কোথায় রইল আমার বেলোয়া সুন্দরীরে–”
গানের পর গান চলিতে থাকে। দুপুরের বেলা গড়াইয়া পড়ে। স্নানের বেলা যায়। তবু তাদের নেশা থামে না। আজাহের মনে মনে ভাবে সে নিজেই যেন আমির সাধু, তার সেই অনাগত বউ-এর খোঁজে সে যেন এমনি করিয়া সারিন্দা বাজাইয়া বাজাইয়া ফিরিতেছে।
রহিমদ্দীর বউ ঘরের আড়াল হইতে কয়, “বলি আমাগো বাড়ির উনি কি আইজ দিন ভইরা গীদই গাবি নাকি? ওদিক যে বাত জুড়ায়া গ্যালো!”
রহিমদ্দী তাড়াতাড়ি স্নান করিতে রওয়ানা হয়। স্নানের ঘাট পর্যন্ত আজাহের তার সঙ্গে সঙ্গে যায়। কিছুতেই কথাটা সে ভালমত করিয়া গুছাইয়া বলিতে পারে না। কোথাকার লজ্জা আসিয়া সমস্ত মুখখানা চাপিয়া ধরে। রহিমদ্দী পিছন ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করে, “কিরে আজাহের, আর কুনু কতা আছে নাকি?”
আজাহের বলে,–“তুমি যে ওই লালে আর নীলে মিশায়া একখানা শাড়ী বুনাইছাও না? পাইড়ে দিছাও সোনালী সূতা, ওখানার দাম কতো?”
“তা তুই কাপড় দ্যা করবি কি? বিয়া ত করিস নাই?”
লজ্জায় একেবারে মাটির সঙ্গে মিশিয়াই আজাহের বলে, “বিয়া ত একদিন করবই।”
রহিমদ্দী হাসিয়া উত্তর করে, “তা যহন তোর বিয়া অবি, কাপড় নিয়া যাইস। তোর কাপড়ের দামে আট আনা কম নিব।” কৃতজ্ঞতায় আজাহেরের সমস্ত অন্তর ভরিয়া ওঠে।
রহিমদ্দী স্নান করিতে নদীতে নামে। তাঁতীপাড়া এখন নিস্তব্ধ। তাঁতীরা কেহ স্নান করিতে গিয়াছে, কেহ স্নান করিয়া কাঠের চিরুণী দিয়া মাথা আঁচড়াইতেছে। কেহ খাইতে বসিয়াছে। বাড়ির বাহিরে রঙ বেরঙের কাপড় মাড় লাগাইয়া গাছের ডালে বাধিয়া রৌদ্রে শুখাইতে দেওয়া হইয়াছে।
আজাহের কাপড়গুলির পানে চায়, আর মনে মনে চিন্তা করে, কোন্ কাপড়খানা তার বউকে মানাইবে ভাল। তার বউ যদি ফর্সা হয়, একেবারে সরষে ফুলের মতো ফর্সা, তবে ওই নীলের উপর হলুদের ডোরাকাটা শাড়ীখানা সে তার জন্য কিনিয়া লইবে। কিন্তু বউ যদি তার কালো হয়, তা হোক, ওই যে কালোর ওপর লাল আর আছা হলুদের। ফুল-কাটা পাড়ের শাড়ীখানা, ওইখানা নিশ্চয় তার বউকে মানাবে ভাল। আচ্ছা, বরান খার মেয়ে আসমানীর মত পাতলা ছিপছিপে যদি তার গায়ের গড়ন হয়, তবে ওই যে পাড়ের উপর কলমীফুল আঁকা শাড়ীখানা, ওইখানা তার বউ-এর জন্য কিনিলে হয় না? কিন্তু তার বউ যদি দেখিতে খারাপ হয়? তা যেমন কেন হোক না, তাঁতীপাড়ার সব চাইতে সুন্দর শাড়ীখানা সে তার বউ এর জন্য কিনিয়া লইবে। একটা বউ তার হইলেই হয়। রাঙা শাড়ীর ঘোমটার আড়ালে সে তার মুখখানা ঢাকিয়া বাড়ির উঠানে ঘুরিবে ফিরিবে। কি মজাই না হইবে! শিস দিয়া গান গাহিতে গাহিতে আজাহের তাঁতীপাড়া ছাড়িয়া চাষীপাড়ার দিকে যায়।