- বইয়ের নামঃ বোবা কাহিনী
- লেখকের নামঃ জসীম উদ্দীন
- প্রকাশনাঃ পলাশ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. আজাহেরের কাহিনী
বোবাকাহিনী – উপন্যাস – জসীম উদদীন
উৎসর্গ
ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজী সাহিত্যের প্রধান পরিচালক অধ্যাপক নূরউদ্দীন আহম্মদের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশে। আমার আদরের ছোট ভাই নূরু! গত ১লা জুলাই তোমাকে কবরের ঘরে শোয়াইয়া আসিলাম। তুমি দেশের জনগণকে ভালবাসিতে। অধ্যাপক হইয়াও তুমি নিজ হাতে কৃষিকাজ করিয়া দেশের মজলুম জনগণের সঙ্গে একত্র হইতে প্রয়াস পাইয়াছ। তাই আমার এই বোবা কাহিনী তোমারই উদ্দেশে উৎসর্গ করিলাম।
তোমার মেঝোভাই
১০ নং কবি জসীমউদ্দীন রোড
পলাশ বাড়ি
কমলাপুর, ঢাকা-১৪
১-৮-৬৪
.
০১.
আজাহেরের কাহিনী কে শুনিবে?
কবে কোন্ চাষার ঘরে তার জন্ম হইয়াছিল, কেবা তার মাতা ছিল, কেবা তার পিতা ছিল, সে কথা আজাহের নিজেও জানে না। তার জীবনের অতীতের দিকে যতদূর সে চাহে, শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার। সেই অন্ধকারের এক কোণে আধো আলো আধো ছায়া এক নারী-মূর্তি তার নয়নে উদয় হয়। তার সঙ্গে আজাহেরের কি সম্পর্ক তাহা সে ভাল করিয়া বুঝিতে পারে না কিন্তু সেই নারী-মূর্তিটি বড়ই করুণ, বড়ই মমতাময়ী। তার কথা ভাবিতে আজাহেরের বড়ই ভাল লাগে। তার মনে বলে সেই করুণ নারী-মূর্তিটি অবলম্বন করিয়া সে যেন অনেক স্নেহের,অনেক মমতার সম্পর্ক পাতাইতে পারে। কিন্তু দিন উপার্জন করিয়া যাহাকে পেটের অন্ন জোগাইতে হয়, এ সব ভাবিবার অবসর তার কোথায়? সংসারে নানা কাজের নিষ্পেষণে সেই নারী-মূর্তিটি কোন্ অনন্ত অন্ধকারে মিলাইয়া যায়।
গ্রামের ফকির সারিন্দা বাজাইয়া গান করে :
নাইকা মাতা, নাইকা পিতা, নাইকা সোদ্দের ভাই,
সেঁতের শেহলা হয়া ভাসিয়া বেড়াই।
তেমনই স্রোতের শেহলার মত সে ভাসিয়া আসিয়াছে। এক ঘাট হইতে আর এক ঘাটে, এক নদী হইতে আর এক নদীতে। যতদূর তার মনে পড়ে সে কেবলই জানে, এর বাড়ি হইতে ওর বাড়িতে সে আসিয়াছে; ওর বাড়ি হইতে আর একজনের বাড়িতে সে গিয়াছে। কেহ তাহাকে আদর করিয়াছে–কেহ তাহাকে অনাদর করিয়াছে, কিন্তু সবাই তাহাকে ঠকাইয়াছে। খেত-খামারের কাজ করাইয়া, গরু বাছুরের তদারক করাইয়া মনের ইচ্ছামত সবাই তাহাকে খাটাইয়া লইয়াছে। সে যখন বেতন চাহিয়াছে তখন গলাধাক্কা দিয়া বাড়ির বাহির করিয়া দিয়াছে।
এমনি করিয়া নানা লোকের কাছে ঠকিতে ঠকিতে এখন তার বয়স পঁচিশের কোঠায়। আর সে কাহারো কাছে ঠকিবে না। নিজের বেতন ভালমত চুকাইয়া না লইয়া সে কারো বাড়িতে কাজ করিবে না–কিছুতেই না। এই তার প্রতিজ্ঞা।
কিন্তু নিজের বেতন চুকাইয়া লইয়া সে কি করিবে? তার মা নাই, বাপ নাই, ভাই নাই, ছোট একটি বোনও নাই। বেতনের টাকা লইয়া সে কার হাতে দিবে?
সবারই বাড়ি আছে–ঘর আছে। ঘরে বউ আছে। আচ্ছা এমন হইতে পারে না? মাঠটির মাঝখান দিয়া পথটি চলিয়া গিয়াছে–সেই পথের শেষে, ওই যে গ্রামখানা, তারই এক কোণে ছোট্ট একখানা ঘর,নল-খাগড়ার বেড়া। চার ধারের মাঠে সরিষার ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে–সেই ছোট্ট ঘরখানিতে ঘোমটা পরা একটি বউ। ভাবিতে আজাহেরের মুখখানা লজ্জায় রাঙা হইয়া যায়। ঘোমটা পরা একটি বউ, না-ফর্সা, না-কালো, না-সুন্দর, না-কুৎসিত। এ সকল সে চিন্তাও করে না। একটি বউ–সমস্ত সংসারে যে শুধু তাকেই আপন বলিয়া জানে। বিপদে আপদে যে শুধু তাকেই আশ্রয়দাতা বলিয়া মনে করে; এমনই একটি বউ যদি তার হয়! ভাবিতে ভাবিতে তার দেহ-মন উৎসাহে ভরিয়া উঠে। যেমন করিয়াই হোক সে তিনকুড়ি টাকা জোগাড় করিবেই। টাকা জোগাড় হইলেই সে মিনাজদী মাতব্বরের বাড়ি যাইবে। মাতব্বর টাকা দেখিলেই তার একটি বিবাহের। বন্দোবস্ত করিয়া দিবে। তিনকুড়ি টাকার আড়াই কুড়ি টাকা সে ইতিমধ্যেই সংগ্রহ করিয়া ফেলিয়াছে, আর দশ টাকা হইলেই তিনকুড়ি টাকা হয়।
গ্রামের চাষীদের যখন কাজের বাড়াবাড়ি তখন তাহারা বেতন দিয়া পৈড়াত বা জন খাটায়। আজাহের এইরূপ পৈড়াত বেচিয়া জীবিকা নির্বাহ করে। সারাদিন গৃহস্থ বাড়ি কাজ করে, তাহাতে চার আনা করিয়া সে পায়। এমনই করিয়া যদি তাহার উপার্জন চলে তাহা হইলে আর চল্লিশ দিন পরে তাহার হাতে দশ টাকা হইবে। আড়াইকুড়ি আর দশ,–তিনকুড়ি। কিন্তু আরও চল্লিশ দিন পরে–আরও একমাস দশদিন পরে–সে কত দূর? দুই হাতে টানিয়া টানিয়া সে যদি দিনগুলিকে আরও আগাইয়া আনিতে পারিত?
সারারাত জাগিয়া জাগিয়া আজাহের পাটের দড়ি পাকায়। বাঁশের কঞ্চি দিয়া ঝুড়ি তৈয়ার করে। এ সব বিক্রি করিয়া সে যদি আরও চার পাঁচ টাকা বেশী জমাইতে পারে; তবে মাতব্বরের নির্দিষ্ট তিনকুড়ি টাকা জমাইতে তাহার আরো কয়েকদিন কম সময় লাগিবে।
আজাহের দ্বিগুণ উৎসাহের সঙ্গে কাজ করে। কাজকর্মের মধ্যে যখন একটু ফুরসৎ পায়–সামনের তাঁতীপাড়ার রহিমদ্দী কারিকরের বাড়িতে যাইয়া সে বসে। লাল, হলুদ, নীল, কত রঙের শাড়ীই না কারিকরেরা বুনাইয়া চলিয়াছে। কোথাও গাছের গোড়ার সঙ্গে নানা রঙের তেনা বাধিয়া মাজন দিতেছে। ফজরের রঙীন মেঘ আনিয়া এখানে কে যেন মেলিয়া ধরিয়াছে। বেহেস্ত হইতে লাল মোরগেরা যেন এখানে আসিয়া পাখা মেলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। চাষার ছেলে আজাহের–সে অত শত ভাবিতে পারে না। শাড়ীগুলির দিকে সে চাহিয়া থাকে–আর মনে মনে ভাবে এর কোন্ শাড়ীখানা তার বউকে মানাইবে ভাল। মনে মনে ভাবিতে ভাবিতে তার মনটি শাড়ীরই মত রাঙা হইয়া ওঠে।