পূর্ব্ব রাত্রিতে চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে যে বৈঠক বসিয়াছিল, তাহাতে কথাবার্ত্তা বেশীদূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। রমাসুন্দরীর তেজে সকলেই যেন একটু সংকুচিত হইয়া গিয়াছিলেন। তদ্ব্যতীত আরও একটা কারণ ছিল। সুবর্ণপুর গ্রামের সমস্ত সামাজিক ব্যাপারের যিনি অধিনায়ক বা অধিনায়িকা, তিনি সে বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি আর কেহই নহেন—গ্রামের পরমপূজনীয় শ্রীযুক্তা শ্যামা ঠাকুরাণী। মুখোপাধ্যায় মহাশয়েরাই বলুন, গাঙ্গুলী মহাশয়ই বলুন, আর মহাপণ্ডিত পুরোহিত ঠাকুরই বলুন, শ্যামা ঠাকুরাণীর কাছে কেহই মনুষ্য-পদ-বাচ্যই নহেন। শ্যামা ঠাকুরাণীই এ গ্রামের সমাজকে শাসনে রাখিয়া থাকেন। পূর্ব্ব রাত্রিতে যখন গোলমাল উপস্থিত হয়, যখন চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে পাড়ার সকলে সমবেত হন, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীকে সংবাদ দেওয়ার কথা যে না উঠিয়াছিল, তাহা নহে। কিন্তু তিনি এই সমস্ত দিন চণ্ডী বাবুর বাড়ীর এত বড় ব্যাপারের কার্য্য শেষ করিয়া সন্ধ্যার সময় গৃহে গিয়াছেন এবং তাঁহার গৃহও গ্রামের অপর প্রান্তে, সেই জন্য এত রাত্রিতে তাঁহাকে বিরক্ত করা কেহই কর্ত্তব্য মনে করেন নাই; সেই জন্যই তাঁহাকে রাত্রিতে সংবাদ দেওয়া হয় নাই; সুতরাং কর্ত্তব্যও নির্দ্ধারিত হয় নাই। প্রাতঃকালে তাঁহাকে সংবাদ দেওয়া হইবে স্থির হইয়া সে রাত্রির মত সভা ভঙ্গ হয়।
এই স্থানে শ্রীযুক্ত শ্যামা ঠাকুরাণীর একটু পরিচয় দিতে হইতেছে। তিনি এই গ্রামেরই কিশোরী ঘোষাল মহাশয়ের কন্যা। ঘোষাল মহাশয়ের যখন স্ত্রী-বিয়োগ হয়, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীর বয়স আট বৎসর। ঘোষাল মহাশয় আর দারপরিগ্রহ না করিয়া মেয়েটীকেই প্রতিপালন করিতে থাকেন। দশম বৎসর বয়সে, তাঁহার যাহা সাধ্য তাহার ও অতিরিক্ত ব্যয় করিয়া শ্যামা বিবাহ দেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ছয়মাস যাইতে না যাইতেই শ্যামা বিধবা হন; তাঁহাকে আর স্বামীর ঘর করিতে হয় না। সেই হইতে শ্যামা ঠাকুরাণী পিত্রালয়েই বাস করিতেছেন। বছর আট পরে যখন কিশোরী ঘোষাল মারা যান, তখন তিনি তাঁহার যে সামান্য জোত-জমা ছিল, তাহা বিধবা কন্যা শ্যামার ভরণ পোষণের জন্য লেখা পড়া করিয়া দিয়া যান। শ্যামার অবর্ত্তমানে ঘোষাল মহাশয়ের জ্ঞাতিদের মধ্যে যাহার আইন অমুসারে প্রাপ্য হইবে, তিনিই বিষয় পাইবেন।
সেই হইতে শ্যামা ঠাকুরাণী এই গ্রামেই বাস করিতেছেন। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন শ্যামা ঠাকুরাণীর বয়স প্রায় ৬০ বৎসর; কিন্তু তাঁহাকে দেখিলে কেহ চল্লিশের উপর বলিয়া কিছুতেই মনে করিতে পারেন না। দশ বৎসর বয়সে বিধবা হইয়া এই পঞ্চাশ বৎসর কাল শ্যামা ঠাকুরাণী নিষ্কলঙ্ক জীবন যাপন করিয়া আসিতেছেন; সুবর্ণপুরের কেহ কোন দিন তাঁহার চরিত্র সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারে নাই। এই চরিত্রবলেই শ্যামা ঠাকুরাণী গ্রামে একাধিপত্য করিয়া আসিতেছেন। তাঁহার যে জমাজমি আছে, তাহার আয় হইতে তাঁহার বেশ চলিয়া যায়; গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কাহারও মুখের দিকে চাহিতে হয় না; জমাজমির ব্যবস্থার জন্যও শ্যামা ঠাকুরাণী কাহারও মুখাপেক্ষা করেন না; নিজেই সমস্ত করেন। দশ টাকা সুদেও তিনি লাগাইয়া থাকেন; সকলে বলে তাঁহার হাতেও কিছু আছে।
তাহার পর শ্যামা ঠাকুরাণী পরোপকারে কখনও পরান্মুখ নহেন; গ্রামের সকলেরই বিপদ-আপদে তিনি বুক দিয়া পড়িয়া থাকেন। এই সকল গুণের জন্য সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা করে। আবার সকলে তাঁহাকে বিশেষ ভয়ও করে, কারণ শ্যামাঠাকুরাণীর মুখের সম্মুখে কাহারও দাঁড়াইবার যো নাই; রাগ ও অভিমান তাঁহার অত্যন্ত বেশী; তাঁহার মতের প্রতিবাদ করিলে আর রক্ষা নাই; তিনি তখন একেবারে উগ্রচণ্ডা হইয়া উঠেন। তাঁহার অভিমানে আঘাত করিতে কেহই সাহস করে না। সকলেই তাঁহার পরামর্শমত কাজ করিয়া থাকে।
রমাসুন্দরী যে অতি প্রত্যুষেই মানদা ও তাহার মেয়েকে লইয়া চলিয়া যাইবেন, একথা রাত্রিতে কেহই ভাবেন নাই; তিনি যদিও সে কথা বলিয়াছিলেন, কিন্তু সকলেই মনে করিয়াছিলেন যে, প্রাতঃকালে শ্যামা ঠাকুরাণীর সহিত পরামর্শ করিয়াই রমাসুন্দরী কর্ত্তব্য স্থির করিবেন। রাত্রিতে যাহাই বলুন, শ্যামা ঠাকুরাণীকে উপেক্ষা করিয়া রমাসুন্দরী কিছুই করিবেন না, এ কথা সকলেই স্থির জানিতেন। শ্যামা ঠাকুরাণী যদি রমাসুন্দরীর প্রস্তাবে মত না দেন, তাহা হইলে মানদাকে লইয়া যাওয়া অসম্ভব হইবে, এই কথা ভাবিয়াই রমাসুন্দরী প্রাতঃকালেই যাত্রা করিয়াছিলেন; পাড়ার কেহই সে কথা জানিতেও পারে নাই; চণ্ডী বাবুও তাঁহার ভগিনীকে নিষেধ করিতে সাহসী হন নাই; তাঁহার যাহা বক্তব্য, তাহা তিনি পূর্ব্ব রাত্রিতেই বলিয়াছিলেন। রমাসুন্দরীকে ত তিনি চটাইতে পারেন না, ভগিনীর সাহায্যেই তিনি এখন গ্রামের দশজনের একজন। এ অবস্থায় তিনি আর আপত্তি করিলেন না। রমাসুন্দরী চলিয়া যাইবার পর কথাটা ক্রমে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল।
শ্যামা ঠাকুরাণী এত বড় ব্যাপারের কিছুই রাত্রিতে জানিতে পারেন নাই। পূর্ব্বদিন চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে অধিক পরিশ্রম হওয়ায় পরদিন শয্যা ত্যাগ করিতে তাহার একটু বিলম্বই হইয়াছিল। তিনি যখন ঘরের বাহিরে আসিয়া প্রাত্যহিক কাজকর্ম্মে হাত দিয়াছেন, এমন সময় প্রতিবেশিনী হরি সরকারের মা আসিয়া বলিল “ও দিদি! তুমি বুঝি এই উঠ্লে? রাতের খবর বুঝি কিছুই জান না?”