মানদা অন্যমনস্ক ভাবে বলিলেন “হ্যাঁ—তা—হ্যাঁ কি বলছ ?”
রমাসুন্দরী বলিলেন “কা’ল সকালে আমি তোদের দেবীপুরে নিয়ে যাব, বুঝলি ?”
মানদা তেমনই ভাবে বলিলেন “আমাদের-দেবীপুরে! কেন? সে কোথায়? দেবীপুরে? কেন? এ যে আমার সুবর্ণপুর। না, না, ওগো, আমি কোথাও যেতে পারব না—যাব না গো ! আমি এই সুবর্ণপুরেই মরব। তোমরা জান না, আমি নয় বছর বয়সের সময় এই সুবর্ণপুরে এসেছি, আর এতকাল এখানেই আছি, —কোন খানেই ত যাই নাই। এখানেই আজ আমার শেষ হবে। তিনি যে আমাকে এই ঘরে এনে তুলেছিলেন! আমি কি এ ঘর ছেড়ে যেতে পারি। না, না—আমি কোথাও যাব না; আমি আজ এই ঘরে—ঐ যে তিনি এসেছেন—ঐ যে তিনি আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আমি এই ঘরের মধ্যেই মরব। আজই আমার যাবার দিন! তোমরা কেউ আমাকে বাধা দিও না—দিও না। কি বলছ—সুহার, হ্যাঁ, সুহার! তা—আমি ওকেও নিয়ে যাব। ওর গলা-টিপে মেরে ফেলে তার পর আমিও মরব। ঐ শোন না তোমরা, তিনি যে সেই কথাই বল্ছেন। আমি কোন দিন তাঁর কোন কথা অমান্য করি নি; আজও তাঁর কথা-মতই কাজ করব। তোমার পায়ে পড়ি গিন্নি! আমাদের নিয়ে যেও না। তোমরা সরে যাও—তোমরা আমাদের ছেড়ে দেও; আমরা মায়েঝিয়ে তাঁর কাছে চলে যাই। তিনি ত ঘৃণা করছেন না—তিনি যে কোলে তুলে নিতে ডাক্ছেন। যাই গো—যাই—আর কি দেরী করা যায়—তিনি যে ডাক্ছেন—ঐ শোন।” বলিয়াই মানদা অচৈতন্য হইয়া পড়িলেন। তাঁহার এই অবস্থা দেখিয়া সুহার কাঁদিয়া উঠিল “মা, ও মা! মা যে কথা বলে না।”
রমাসুন্দরী তাড়াতাড়ি উঠিয়া বাহির হইতে জল আনিয়া মানদার মুখে-চোখে মাথায় ছিটাইয়া দিতে লাগিলেন। তাঁহার নাড়ীজ্ঞান ছিল; মানদার হাত দেখিয়া বলিলেন “ভয় নাই, মুর্চ্ছা গিয়েছে; এখনই জ্ঞান হবে। তোমরা ভাল করে বাতাস কর।”
ধীরে ধীরে বাতাস করিতে করিতে মানদার জ্ঞান-সঞ্চার হইল ; তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া অতি কাতর স্বরে বলিল “মাগো, আর যে সয় না।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “মানদা, সবই সইতে হবে। সুহারের মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখ্,; মেয়ে যে কেমন হয়ে গিয়েছে।”
“সুহার! আমি তার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ত, সুহারকে ফেলে কোথায় যাব। আয় মা, আয় আমার কোলে আয়। তোকে বুকে করে দেখি আগুন নেবে কি না।”
রমামুন্দরী বলিলেন “মানদা, অত কাতর হলে চল্বে না। তুই মরবি কেন ? তোর কি হয়েছে। আমার কথা বেশ করে বুঝে দেখ, তোর কিছুই হয় নাই। তুই যে ভগবানের কাছে খাঁটি আছিস্। বল দেখি, আমার কথা ঠিক কি না ?”
মানদা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিলেন। কেহই কোন কথা বলিয়া তাঁহার এই ভাবনায় বাধা দিলেন না। অবশেষে মানদা অতি ধীর ভাবে বলিলেন “গিন্নি, তোমার কথা আমার মনে লেগেছে। তুমি ঠিক কথা বলেছ। তাই ত! আমি যদি মনে প্রাণে ঠিক থাকি, তা হলে আর চাই কি। আমি বল্ছি তোমাকে গিন্নি! আমি কোন পাপই করি নাই—আমার মন ঠিকই আছে। আমি তাঁরই স্ত্রী আছি! আমি কোন অন্যায় কাজ করি নাই। যে যা বলে বলুক, না, কি বল গিন্নি, আমি খাঁটি আছি।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “আমার কথা তা হলে বুঝেছিস্ ত! তবে আর অমন করছিস্ কেন ?”
মানদা তেমনই ধীর ভাবে বলিলেন “তা ত বুঝেছি গিন্নি, কিন্তু লোকে কি বলবে ? সকলে যে আমাকে কত কি বল্বে—আমার সঙ্গে কথা বল্বে না। তা হলে আমি কেমন করে বাঁচব? তা হলে আমার সুহারের কি গতি হবে ? তার যে বার বছর বয়স হোলো। তাকে কে নেবে গিন্নি! আমার সুহার! ”
রমামুন্দরী বলিলেন “সে কথা যে তোকে একটু আগেই আমি বল্লাম, তা বুঝি শুনতে পাস্নি; তুই স্থির হয়ে শোন্। আমি তোদের দেবীপুরে নিয়ে যাব। সেখানে কেউ তোকে ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য করতে পারবে না। আর যেমন করে হোক, তোর সুহারকে আমি ভাল ঘর বর দেখে বিয়ে দিয়ে দেব।”
মানদা বলিলেন “তা আর হয় না গিন্নি ! আর হয় না । মনে ত বল বেঁধেছিলাম; কিন্তু সব যে ভেঙ্গে পড়ে। তা আর হবে না।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “হয় কি না হয়, সে আমি দেখে নেব । তুই এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর্ দেখি !”
মানদা বলিলেন “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক কথা বলেছ! আহা, ঘুমাতে হবে বই কি! ঘুমই যে এখন আমার একমাত্র পথ। মা দুর্গা, আমার চোখে একবার ঘুম এনে দাও মা! সে ঘুম যেন আর না ভাঙ্গে! ওগো, দয়াময়ী, আর তোমার কাছে কিছু চাইনে, আমার চোখে ঘুম এনে দাও—আমি সব ভুলে যাই—সব ভুলে যাই।”
রমামুন্দরী বলিলেন “আবার ও কি কথা ! তুই একটু স্থির হ, মানদা! রাত যে অনেক হয়ে গেল !”
মানদা চারিদিকে একবার চাহিয়া বলিলেন “তাই ত, রাত যে অনেক হোয়েছে! ও সুহার! তুই একটু ঘুমিয়ে নে মা! অসুখ করবে যে। আয়, আমার কোলের কাছে আয়!” এই বলিয়া সুহারকে কোলের মধ্যে তুলিয়া লইয়া মানদা নীরব হইলেন।
রমাসুন্দরী এবং আরও দুই তিনটি স্ত্রীলোক সারা রাত্রি সেই স্থানেই বসিয়া কাটাইলেন। মানদা কখন চুপ করিয়া থাকেন, কখন আপন মনেই কত কথা বলেন; কেহই কিন্তু সে সকল কথার উত্তর দিলেন না।
এমনই করিয়া সেই কালরাত্রির অবসান হইল। প্রাতঃকালে রমাসুন্দরী জোর করিয়া মানদা ও সুহারকে নৌকায় লইয়া গেলেন। একটু পরেই তাঁহাদের নৌকা সুবর্ণপুর ত্যাগ করিল।
০৬. পূর্ব্ব রাত্রিতে চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে