সিদ্ধেশ্বর বলিলেন, “সে বিবেচনা পরে করা যাবে। আপাততঃ ওঁকে ত দেবীপুরে নিয়ে যাই। তারপর যা হয়, দেখব, কি বল মা?”
রমাসুন্দরী বলিলেন “সেই কথাই ভাল। সকালেই আমাদের যাওয়ার বন্দোবস্ত করে ফেলো সিধু! ঘাটে ত নৌকা বাঁধাই আছে; কালই রওনা হতে হবে। আমি এখন ও-বাড়ী যাই; মানদাকে আজ রাত্রিতে চোখের আড়াল করা হবে না।” এই বলিয়া তিনি কালাচাঁদদিগের বাড়ীতে চলিয়া গেলেন।
০৫. কি হবে গিন্নি
“কি হবে গিন্নি?”
“কিসের কি হবে বড়-বৌ ?”
“বড় বৌ! ও নাম ধরে আর আপনি আমাকে ডাক্বেন না। বড়-বৌ! সে ত নেই। সে নেই গো! সে আর নেই! আজি সন্ধ্যা পর্যন্তও আমি এক গৃহস্থের বড়-বৌ ছিলাম গিন্নি! এখন আর তা নেই! সে সব আমার ঘুচে গেছে—চিরদিনের মত গেছে। কাল সকালে আর তার চিহ্নও থাক্বে না। সে কথা বল্ছিনে গিন্নি, মেয়েটার কি হবে? আমি চলে গেলে, কে তাকে দেখ্বে? সে কার কাছে দাঁড়াবে? তার যে আর কেউ নেই।” মানদা আর কথা বলিতে পারিলেন না; তিনি কাঁদিয়া উঠিলেন।
রমাসুন্দরীর কাছেই সুহার দাঁড়াইয়া ছিল; তিনি তাহাকে মানদার কোলের কাছে বসাইয়া দিতে গেলেন। মানদা চীৎকার করিয়া সরিয়া বসিলেন; বলিলেন “না, না, ওরে সুহার, তুই আমাকে স্পর্শ করিস্ না, আমার কাছে আসিস্ না। সরে যা মা আমার, সরে যা। তোর মা নেই! তোর মা যে সন্ধ্যার পরে মরে গিয়েছে রে”-
সুহার সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া মায়ের গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল “মা, ও মা, তুমি অমন করছ কেন? ওগো, তোমরা দেখ, মা যে কেমন করছে।” সুহার কাঁদিয়া উঠিল।
রমাসুন্দরী মানদাকে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরিয়া বসিলেন; কিন্তু, কি যে বলিবেন, তাহা ভাবিয়া পাইলেন না। এ দৃশ্য দেখিয়া তাঁহার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল। যে দুইচারি জন স্ত্রীলোক সেখানে ছিলেন, তাঁহারা বলিলেন “ও বড়বৌ, অমন করছিস্ কেন? দেখ্ ত, সুহার কাঁদছে। ওকে কোলে কর; ওর মুখের দিকে চেয়ে সব ভুলে যা।”
মানদা বলিলেন “সব ভুলে যাব—সব আমি ভুলে যাব। আর একটু অপেক্ষা করুন আপনারা, আমি সব ভুলে যাব। ওগো, তোমরা কেউ আমার এই অভাগী মেয়েটাকে কোলে তুলে নেও; তোমরা কেউ বল যে, ওর মুখের দিকে চাইবে। তা হলেই আমি যাই। গিন্নি, আপনিই একবার বলুন! আপনার পায়ে ধরে বলছি, এই আমার শেষ প্রার্থনা-আপনি এই বাপ-মা-হারা মেয়েটাকে নিন্—আমি চলে যাই। আর যে আমি দেরী করতে পারছি নে। আর যে আমার সহ্য হচ্চে না। দেখ্বে তোমরা—এই দেখ না আমার বুকের মধ্যে কি আগুন জ্বলছে-আমার মাথা দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে। আর যে আমি থাক্তে পারছি নে। আয় সুহার, তুইও আমার সঙ্গেই আয়! এ দেশে তোরও থেকে কাজ নেই। না, না, তোকে রেখে যাব না-তোকেও সঙ্গে করেই নিয়ে যাই। চল্ মা, চল্ অভাগীর মেয়ে, আমার সঙ্গে চল। ঐ নদীতে ডুবে সব জ্বালার হাত থেকে নিস্তার-পাই গে! চল্ মা, চল্; এখানে তোর কেউ নেই। চল্।” এই বলিয়া পাগলিনীর মত সুহারের হাত ধরিয়া মানদা দণ্ডায়মান হইতে গেলেন ।
রমাসুন্দরী তাহাকে জোরে কোলের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন “ও বড়বৌ, তুই পাগল হলি না কি? ও-সব কি বকৃচিস্। কি, তোর হয়েছে কি?”
মানদা বলিলেন “কৈ, কি হবে? না, না, কিছুই হয় নাই। হবে আবার কি? তোমরা সবাই সরে যাও, আমাকে ছেড়ে দেও, আমি মেয়ে নিয়ে চলে যাই। এখানে যে আমি থাক্তে পারছি নে, এ ঘরের দিকে যে আমি চাইতে পারছি নে। ওরে, এ যে আমার দেবতার ঘর ছিল রে! তোমরা কেউ এই ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে পার? আমি তা হলে এই ঘরের মেজেয়—ঐ ঐখানে বসে সেই আগুনে পুড়ে মরি।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “ও সব কি কথা বল্ছিস মানদা? তুই চুপ কর্। তোর ভয় কি? আমি আছি। তোর মেয়ে সুহারের জন্য তোর ভাবনা হয়েছে? আমি ধর্ম্ম সাক্ষী করে বল্ছি, তোর মেয়েকে আমি নিলাম; তার সম্পূর্ণ ভার আমার উপর রইল। তুই এখন একটু স্থির হয়ে আমার কথা শোন্। আমি এ কথা মানি যে, নরাধমের স্পর্শে তোর দেহ কলুষিত হয়েছে। পশুটা যখন পাপ মনে তোর গায়ে হাত দিয়েছে, তখনই তোর শরীর অপবিত্র হয়েছে। কিন্তু তোর মন ত অপবিত্র হয় নাই; এ কথা ত তুই বেশ বুঝিস্। তোর মনে ত কোন পাপ স্পর্শ করে নাই, তা ত তুই জানিস্, তবে এত কাতর হচ্চিস্ কেন? লোকে কত কথা বল্বে, কেমন? আমি তার ব্যবস্থা করেছি। আমি তোকে আর তোর মেয়েকে দেবীপুরে নিয়ে যাব। তুই সেখানে আমার মেয়ের মত থাক্বি; আমি তোকে কোলে করে রাখব; তোকে আমার সংসারের কর্ত্রী করে রাখব। কেউ তোকে ঘৃণা করতে পারবে না। তোর মেয়ের বিয়ে যাতে সুপাত্রের সঙ্গে হয়, আমি তা করব। তোকে এ দেশে থাক্তে হবে না;–এ মুখুয্যে-বাড়ী আর তোকে আস্তে হবে না,—এদের মুখ তোকে দেখ্তে হবে না। এর জন্য যত কিছু সহ্য করতে হয়, আমি করব। কা’ল সকালেই তোদের নিয়ে আমি দেবীপুরে চলে যাব।”
মানদা অবাক হইয়া রমামুন্দরীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তিনি নিজের কর্ণকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না; পাগলিনীর মত তাঁহার শূন্যদৃষ্টি !
রমাসুন্দরী বুঝিতে পারিলেন, মানদা তাঁহার কথার মর্ম্মগ্রহণ করিতে পারেন নাই, তাঁহার বুদ্ধি এখন প্রকৃতিস্থ নহে। তিনি বলিলেন “মানদা, আমি যা বললাম, শুন্তে পেয়েছিস্ ?”