রমামুন্দরী তীক্ষ দৃষ্টি পুত্রের মুখে নিবদ্ধ করিলেন; একটু চুপ করিয়া থাকিয়াই কহিলেন “পথ দেখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু সে পথে চল্তে পারবি সিধু!”
সিদ্ধেশ্বর দৃঢ় স্বরে বললেন “তুমি যদি আদেশ কর মা, তুমি যদি সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাক, তা হলে তোমার এই অযোগ্য সন্তান সব করতে পারে।”
“তবে শোন্ সিধু, আমি যে এতক্ষণ কেনারামের সঙ্গে তর্ক করছিলাম, সে তোর মন বোঝবার জন্য; সুবর্ণপুরের কালু মুখুয্যের জন্য আমার মাথাব্যথা পড়ে নাই। আমি ভাবছিলাম মানদার কথা—আমি ভাবছিলাম তোর কথা সিধু! আমার সে বাসনা পূর্ণ হয়েছে। তুই আমাকে পথের কথা জিজ্ঞাসা করবি, তারই জন্য এতক্ষণ এত কথা-বল্ছিলাম। শোন তবে আমার পথের কথা। আমি মানদাকে ঘরে নিয়ে যাব-দেবীপুরে নিয়ে যাব। এতদিনে দেবীপুরের নাম সার্থক করব। কেমন, পারবি এ ভার নিতে?”
“বলেছি ত মা, তোমার আদেশ প্রতিপালনে জন্য সব করতে পারব।”
চণ্ডী বাবু এতক্ষণ কোন কথাই বলেন নাই; এখন দেখিলেন ব্যাপার গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল। তিনি আর নীরব থাকিতে পারিলেন না; বলিলেন “দিদি, সকল দিক ভেবে দেখেছ কি ? ওবাড়ীর বড়-বৌয়ের অবস্থার কথাই এখন তোমার মন অধিকার করে বসেছে; তাই তুমি আর কিছুই ভাবতে পারছ না। একটু স্থির ভাবে চিন্তা করে দেখ্লেই বুঝতে পারবে, কি কাজ তুমি করতে যাচ্চ। এই প্রথমেই ত দেখ, মুখুয্যে বংশের কি কলঙ্ক হবে? এর পর কি আর কোন ভদ্র ব্রাহ্মণ ওদের সঙ্গে আদানপ্রদান করবে? ওদের যে একঘরে হয়ে থাক্তে হবে, সে কথাটা ভেবেছ কি?”
“হাঁ ভাই চণ্ডি, সে কথা ভেবেছি। কালাচাঁদ মুখুয্যে যে পাপ করেছে, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না? তার বংশের কলঙ্ক ত দেশময় ছড়িয়ে পড়াই চাই! তাকে সকলে ঘৃণা করবে, তাই ত চাই। আর তোমরা যদি এমন নরপিশাচের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখ, তা হলে তোমাদেরও ত প্রায়শ্চিত্তের দরকার, তোমাদেরও শাস্তি হইয়া চাই!”
চণ্ডী বাবু বলিলেন “আমাদের কথা না হয় নাই ভাবলে। আমাদের ভাবনা আমরাই ভাবব; কিন্তু তোমাদের কথাটাও ত একবার ভেবে দেখতে হয়। তোমরা দেবীপুরের জমিদার, তা সকলেই জানে। তোমাদের যে সে অঞ্চলে অসীম ক্ষমতা, তাও আমার জান্তে বাকী নেই। তোমরা ইচ্ছা করলে অনেক অসাধ্য-সাধনও করতে পার, এ কথাও স্বীকার করি। কিন্তু, তোমরা কি তোমাদের অঞ্চলের সমাজে যা ইচ্ছা তাই চালাতে পার? এমন ক্ষমতা কি তোমাদের আছে? তারপর ভেবে দেখ, দেবীপুরের তোমরা নয়-আনির জমিদার। সাত-আনির জমিদার মনোহর চাটুর্য্যের সঙ্গে তোমাদের যে রকম মনের মিল, তা আমি বেশ জানি। কেউ কারও ক্রটী দেখ্লে ছেড়ে কথা বলে না। এ অবস্থায় তোমরা যে কাজ করতে যাচ্ছ, তাতে মনোহর বাবু যে তোমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, এ ত আমি দিব্যচক্ষে দেখ্তে পাচ্ছি। তার ফল যে কি হবে, তা আর তোমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। ঘোর একটা দলাদলির সৃষ্টি হবে; তারপর, তার থেকে মনান্তর, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মামলা-মোকদ্দমা—কত কি যে হবে, তা বলা যায় না। কেমন দিদি, কেমন বাবা সিধু, আমার এ কথাগুলো সত্যি কি না, বল দেখি? আমাদের গায়ের এই কেলেঙ্কারী মাথায় করে নিয়ে দেশে গিয়ে একটা কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে তোমাদের কি লাভ হবে, কি পৌরুষ বাড়বে, সেই কথাটা আমাকে বুঝিয়ে দিতে পার? আজ যে অত্যাচার তোমরা স্বচক্ষে দেখ্লে, তাতে তোমাদের কেন, মানুষমাত্রেরই মন বিচলিত হ’তে পারে; কিন্তু, তার প্রতিবিধানের জন্য তোমাদের এত মাথাব্যথা কেন? তার জন্য এমন বিপদ ডেকে আনা কেন?”
রমামুন্দরী বলিলেন “চণ্ডি, তুমি যে সব কথা বল্লে, আমি কি তা ভাবিনি, তুমি মনে করছ। আমি সব ভেবেছি। মানদার অবস্থা দেখে যে আমি বিচলিত হয়েছি, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু, আমি যখন তোমাদের সঙ্গে এই সকল কথার আলোচনা করছিলাম, তখন আমি এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবার ভবিষ্যৎ ফলের কথাও ভাবছিলাম, আর আমার ছেলে সিধুর মুখের দিকে চাচ্ছিলাম। সে মুখে আমি যে দীপ্তি, যে ভাব দেখ্তে পেয়েছি, তাতেই আমি সাহস করে এই ভার নিতে চাচ্ছি। কেমন সিধু ?”
সিদ্ধেশ্বর বলিলেন “মামা, মায়ের আদেশ আমি মাথায় করে নিয়েছি। আজ আমি যে দৃশ্য দেখলাম, এতে আমার প্রাণে যে ভাবের উদয় হয়েছে, তা মামা, তুমি বুঝতে পারবে না। মায়ের আদেশ পেয়েছি। আমি বল্ছি, ও বাড়ীর বড়-বৌকে আশ্রয় দেবার জন্য মনোহর কাকার সঙ্গে যদি বিবাদ করতে হয়, দেশের সকলের সঙ্গে যদি মনান্তর হয়, দেবীপুরের নয়-আনির বাড়ীকে যদি একঘরে হয়ে থাক্তে হয়, তাতেও কুন্ঠিত হব না। দেবীপুরের জমিদারী যদি বিকিয়ে যায়, তাতেও আমার অণুমাত্র দুঃখ হবে না। একটী অসহায়া, নিরপরাধা বিধবাকে সামাজিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করবার জন্য আমার যথাসর্ব্বস্ব দিয়ে আমি পথের ভিখারী হয়েছি, এর চাইতে অধিক গর্ব্বের কথা আমি ভেবেই পাচ্ছি না। মা ঠিক কথা বলেছেন, যে সমাজ নিরপরাধা বিধবাকে এমন করে ত্যাগ করতে পারে, সে সমাজ হিন্দুসমাজ নয়। আমি সে হিন্দুয়ানীর বড়াই করতে চাইনে। না মা, তুমি ভেবো না। তোমার আদেশ পালন করবার জন্য আমি সমস্ত বিপদ মাথায় করে নিতে প্রস্তুত হয়েছি।”
হরিশ গাঙ্গুলী মহাশয় বলিলেন, “তোমরা যে যা বল্লে, সবই ত শোনা গেল। কিন্তু আমি একটা কথা বলি, তাই কেন কর না। ও-বাড়ীর বড়-বৌয়ের জন্য তোমাদের প্রাণে ব্যথা লেগেছে, সে বেশ কথা; কিন্তু, তাকে ঘরে নিতে চাও কোন্ বিবেচনায়? আমরা অবশ্য তাকে আমাদের সমাজে স্থান দিতে পারব না; তোমরাও দেখে নিও, দেবীপুর সমাজেও তার স্থান হবে না; মাঝের থেকে তোমরা অনেক বিপদ, অনেক লাঞ্ছনা ভোগ করবে। সকল দিক যাতে রক্ষা হয়, আমি সেই পরামর্শ দিচ্ছি। তোমাদের অর্থ আছে, তোমরা তা অনায়াসে করতে পার। বেশ ত,তোমাদের দয়া হয়েছে, তোমরা গোরাচাঁদের স্ত্রীকে কাশীতে পাঠিয়ে দেও; সেখানে তার ভরণ-পোষণের জন্য যা ব্যয় হবে, তা তোমরা দিও।. তবে তার মেয়েটার কথা ভাববার বিষয় বটে। তারই বা কি। কাশী হোলো গে একটা সৃষ্টিছাড়া যায়গা। পয়সা খরচ করলে সেখানে বেশ্যার মেয়েও কুলীন বামুনের মেয়ে বলে পার হয়ে যায়; এ ত সামান্য কথা। এই বুড়ো বামুনের কথাটা ভেবে দেখ, সব দিক্ যাতে রক্ষা হয়, আমি সেই সুপরামর্শই দিলাম।”