রমামুন্দরী একটু পূর্বেই কালাচাঁদের বাড়ী হইতে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।তিনি এই গ্রামেরই মেয়ে; তাহার পর তাঁহার বয়সও পঞ্চাশ পার হইয়া গিয়াছে; সুতরাং চণ্ডী বাবুর বৈঠকখানায় যাঁহারা আলোচনা করিতেছিলেন, তাঁহাদের সন্মুখে উপস্থিত হইবার তাঁহার বাধা বা লজ্জার কারণ ছিল না। তিনি চুপ করিয়া কেনারাম ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের সাধুভাষায় বিবৃত শাস্ত্রের বিধান শ্রবণ করিতেছিলেন। ভট্টাচার্য্য যখন তাঁহার বক্তব্য শেষ করিবেন, তখন অন্যের কথা বলিবার পূর্বেই তিনি বলিলেন “কেনারাম, তোমাদের সুবর্ণপুরে যে নুতন শাস্ত্র পাওয়া গিয়েছে, এ সংবাদ ত আমি পাই নাই।”
কেনারাম বলিলেন “নুতন শাস্ত্র কি দিদি ! যে শাস্ত্র আবহমান কাল এই হিন্দুসমাজের কর্ত্তব্য বিধান করিতেছে, আমি সেই শাস্ত্রের কথাই উল্লেখ করিলাম।”
“কৈ, তুমি ত ভাই প্রমাণ কিছুই দিলে না,—দুই দশটা বচনও আওড়ালে না। বচন-প্রমাণ না দেখালে কি আমাদের মত মুর্থ মেয়েমানুষ শাস্ত্র বুঝতে পারে?”
কেনারাম বলিলেন “এ সকল ত অতি সহজ ব্যাপার; ইহার জন্য আর প্রমাণ-প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় না।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “কেনারাম, ভাই, কিছু মনে করো না; আমি জিজ্ঞাসা করি, গোপনে কোন কুকার্য্য করলে তাতে পাপ হয় না ?”
“পাপ হবে না কেন ? কিন্তু এ যে কলিকাল দিদি ! এখন , কি আর সেই সত্যযুগের ব্যবস্থা খাটে ? তাই এখন অনেকটা অন্তরাল করিয়া চলিতে হয়। কুকার্য্যকারী সকলকেই যদি দণ্ডিত করিবার ব্যবস্থা করা যায়, তাহা হইলে কি সমাজ তিষ্ঠিতে পারে। সেই কারণে, যে যাহা অনুষ্ঠান করে, তাহা উপেক্ষা করিতে হয়, নতুবা সমাজের স্থিতি রক্ষা হইবে কি প্রকারে?”
“তা হলে তুমি বলতে চাও যে, যার যা ইচ্ছা, যেমন কুকার্য্য ইচ্ছা, তাই সে করুক; তবে যেন সাবধানে করে, গোপনে করে; তা হলে তোমরা তাদের সমাজে চালিয়ে নিতে পার। এই তোমাদের এখানকার শাস্ত্রের বিধান, কেমন ?”
“না দিদি, তা ঠিক নয়। তবে এই- এই কথাটা-এই কি জান-” কেনারামের কথায় বাধা দিয়া রমামুন্দরী বলিলেন—“কথাটা এই যে, তোমরা শক্তের কাছে নরম, আর নরমের কাছে শক্ত। যাক্ সে কথা। তুমি যে বল্লে, কালাচাঁদ একটা প্রায়শ্চিত্ত করলেই তাকে তোমরা সমাজে তুলে নিতে পার। তার এই ঘোরতর পাপের ঐ সামান্য শাস্তিই তোমাদের শাস্ত্রে লেখা আছে।আর মানদার বেলায় তোমরা ব্যবস্থা করলে যে, সে যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যাক। তোমরা তাকে সমাজে কিছুতেই স্থান দিতে পারবে না। কেমন, এই ত তোমার ব্যবস্থা?” .
কেনারাম বলিলেন “শাস্ত্রের বিধানই এই । ত্রিকালজ্ঞ মুনিঋষিরা যা ব্যবস্থা করে গিয়েছেন, অল্পবুদ্ধি আমরা কি তার অন্যথা করতে পারি, না তার তাৎপর্য্য গ্রহণ করতে পারি।”
রমাসুন্দরী বলিলেন “দেখ কেনারাম, আমিও ব্রাহ্মণের মেয়ে, আমিও শাস্ত্রের বিধান মানি। কিন্তু যে শাস্ত্রর কালাচাঁদের মত মানুষের জন্য অতি সামান্য, অতি হাস্যকর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করতে পারে, আর মানদাকে পথের ভিখারিণী করতে পারে, সে শাস্ত্র মুনিঋষিরা করেন নাই, করতে পারেন না, এ কথা আমি জোর করে বল্ছি। যদি তুমি কোন শাস্ত্র থেকে প্রমাণ দিতে পার, তা হলে আমি তোমার মুখের উপর বলৰ যে, সে শাস্ত্র তোমার এই কালাচাঁদের মত মুনিঋরিাই করেছেন; তা হিন্দুর শাস্ত্র নয়,-প্রকৃত মানুষের শাস্ত্র নয়। অপরাধ করল কালাচাঁদ, মহাপাপ করল কালাচাঁদ, আর তার ফলভোগ করবে সেই অনাথা বিধবা! একবার গিয়ে দেখে এস মানদার অবস্থা, শুনে এস তার কান্না! পাষাণও গলে যায় কেনারাম; পাষাণও গলে যায়! তার অপরাধ কি? বল না তোমরা সকলেই ত এখানে আছ, বল না মানদার কি অপরাধ, ষে তাকে পথে দাঁড়াবার ব্যবস্থা করতে চাও। এই নরপশুটা তাকে আক্রমণ করল; সে নিরুপায়া অবলা; সে কি করবে? প্রাণপণে চীৎকার করা ছাড়া আর কি উপায় তার ছিল, বল না তোমরা? তারপর, তোমরা কি না এখানে বৈঠক করে কালাচাঁদকে ধুয়ে-মুছে ঘরে তুলতে যাচ্ছ, আর মানদাকে অকুল পাথারে ভাসিয়ে দিতে চাও। দেখ, যতই তোমরা বড়াই কর না কেন, আমি বলছি এ মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত তোমাদের করতে হবে, তোমাদের এই সমাজকে করতে হবে। হাঁ, মানদা যদি অসচ্চরিত্রা হত, তা হলে তাকে তোমরা দূর করে দিতে, কেউ একটা কথাও বলতে পারত না। কিন্তু এই ঘটনাটা ভেবে দেখ দেখি। আমি এই এখনই মানদার কাছ থেকে আসছি। তার এখন যে রকম ভাব, তাতে সে নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করবে। তা ছাড়া তার আর কি পথ আছে? আর কি পথ তোমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পার, বল না ?”
রমাসুন্দরীর পুত্র সিদ্ধেশ্বর এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিলেন। তিনি বুদ্ধিমান বিচক্ষণ; তিনি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি; বয়সও তাঁহার ছত্রিশ সাঁইত্রিশ হইয়াছে। ইংরাজী, বাঙ্গালা, সংস্কৃতে এত বড় পণ্ডিত হইয়াও তিনি অল্পভাষী; তাই এতক্ষণ যে বাদ্বিতণ্ডা হইতেছিল,তাহাতে তিনি কোন মতই প্রকাশ করেন নাই। বিশেষতঃ, তাঁহার পূজনীয়া মাতাঠাকুরাণী যখন কেনারাম ভট্টাচার্যের সহিত আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলেন, তখন তিনি সে আলোচনার মধ্যে কথা বলা সঙ্গত মনে করিলেন না। কিন্তু, তাঁহার মাতা যখন বলিলেন “কি পথ তোমরা তাকে দেখিয়ে দিতে পার, বল না?” তখন সিদ্ধেশ্বর অতি ধীর ভাবে বলিলেন “মা, তুমিই একটা পথ দেখিয়ে দেও না।”