কালাচাঁদের একটা গুণ ছিল; সে নানা উপায়ে অর্থ উপার্জ্জন করিত, ন্যায় অন্যায় অবিচার অত্যাচার করিয়া টাকা, সংগ্ৰহ করিত; টাকার জন্য কাহারও প্রাণনাশ করিতেও হয়ত দ্বিধা বোধ করিত না; ব্যয়ের বেলায় কিন্তু সে ভারি হিসাবী ছিল। যাহাদের স্বভাব-চরিত্র খারাপ হয়, তাহারা অপব্যয়ী হইয়া থাকে; তাহাদের হাতে বিষয় বা টাকাকড়ি পড়িলে তাহারা দুইদিনেই উড়াইয়া সৰ্ব্বস্বান্ত হইয়া পড়ে। কালাচাঁদ কিন্তু সে রকমের মানুষ ছিল না। তাহার স্বভাব অতি মন্দ ছিল; কিন্তু সে ব্যাপারেও সে মুক্তহস্ত ছিল না; সে বিশেষ হিসাব করিয়াই অপব্যয় করিত। তাহার রোজগারের অনুপাতে সে ব্যয় অতি সামান্য বলিলেই হয়। সংসার-খরচের দিকেও তাহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল; কোন প্রকারে ছপয়সা বেশী খরচ হইবার যো ছিল না। অথচ কাহার জন্য যে সে জোতজমা বৃদ্ধি করিতেছিল, অর্থ সঞ্চয় করিতেছিল, লগ্নী কারবারে একেবারে পিশাচের ন্যায় ব্যবহার করিত, কাহাকেও একটা পয়সা রেন্থাই দিত না, তাহা বুঝিয়া উঠা যাইত না। স্ত্রীর সহিত তাহার মুখ দেখাদেখিও ছিল না; সে রাত্রিতে বাড়ীতেই থাকিত না। সংসারে অবলম্বন একমাত্র তাহার দাদার মেয়েটী। তাহাকেও সে তেমন আদর-যত্ন করিত না; তাহার জন্যও কখন কোন দ্রব্য কিনিয়া দিত না। তবুও যে কেন যে এমন করিয়া অর্থ উপার্জন করিত, সেই জানে। গোরাচাঁদ যদি কখন কোন বিষয়ে কিছু বলিতেন, তাহা হইলে কালাচাঁদ অতি গম্ভীর ভাবে বলিত, “সময় অসময় আছে দাদা! চারিদিকে দেখে-শুনে খরচ করতে হয়। দু-দশ টাকা হাতে না থাক্লে কি মান-সম্ভ্রম রক্ষা করে চলা যায় না, না দশজনে মানে চেনে।” গোরাচাঁদ আর দ্বিরুক্তি করিতেন না।
এই ভাবেই কয়েক বৎসর গেল। তাহার পরই এই মুখোপাধ্যায় পরিবারে এক অভাবনীয় পৈশাচিক দৃশ্যের অভিনয় হইল। সেই কথা বলিবার জন্যই তাঁহাদের পরিবারের এই পরিচয়টুকু দিতে হইল।
০২. আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি
আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তাহার ছয়মাস পূর্ব্বে গোরাচাঁদ মুখোপাধ্যায় মহাশয় প্রায় মাসাধিক কাল জ্বরে ভুগিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার কন্যা সুহারের বয়স তখন বার বৎসর। মানদার এতদিন যখন সামান্য যাহা প্রয়োজন হইত, গোরাচাঁদকে বলিলেই তাহা পূর্ণ হইত; এখন দুইটী পয়সার প্রয়োজন হইলেই কালাচাঁদের কাছে দরবার করিতে হয়। তিনি কালাচাঁদের সহিত কথা বলিতেন না; সুহারের দ্বারাই কালাচাঁদের কাছে অভাবের কথা জানাইতে হইত। কালাচাঁদ ইহাতে, বড়ই বিরক্ত হইত; বলিত, “কেন? তোর মায়ের মুখ নেই, সে কি বোবা; যখন যা দরকার হয়, আমার কাছে নিজে চাইলেই পারে। তোর মা নিজে মুখে না চাইলে আমি কোন কথা শুনব না।” এই কারণে সুহারও তাহার কাকার কাছে কিছু বলিতে চাহিত না; তাহার মাকে বলিত “মা, তুমি কাকার সঙ্গে কথা বল্লেই পার? তা হ’লে ত কাকা এমন রাগ করতে পারবেন না।”
মানদা বলিতেন, “না মা, তিনি বেঁচে থাক্তে এতকাল যখন ঠাকুরপোর সঙ্গে কথা বলি নাই, তাঁকে দেখে লজ্জা করে এসেছি, এখন কি আর কথা বলা যায়। যাক্, আমার আর কয় দিনই বা ভিক্ষা করতে হবে। কোন রকমে তোকে পার করতে পারলেই হয়; তারপর আর আমার কিছুরই দরকার হবে না।”
এদিকে কালাচাঁদও যেন একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিল। সে যখন-তখনই বাড়ীর মধ্যে আসিয়া “বড় বৌ, এটা দেও, ওটা দেও” বলিয়া মানদাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলে; ঠাট্টা-তামাসার মাত্রাও যেন ক্রমেই বাড়িয়া যাইতে লাগিল। মানদার বয়স তখনও বেশী হয় নাই; পনর বৎসর বয়সে সুহার জন্মগ্রহণ করে; সুহারের বয়স এখন বার বৎসর; সুতরাং মানদা সাতাশ বৎসরের যুবতী। তাঁহার শরীরেও কোন রোগ ছিল না।
কালাচাঁদ এতদিন বাহিরেই বেশী থাকিত; বিশেষ প্রয়োজন না হইলে বাড়ীর মধ্যে আসিত না; এবং যখন যাহা চাহিত, মানদা মন্দাকিনীর দ্বারাই তাহা যোগাইয়া দিতেন, নিজে বড়-একটা সম্মুখে যাইতেন না। ইহাতে মন্দাকিনীকে সৰ্ব্বদাই লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইত, স্বামীর কটূক্তি শুনিতে হইত; কিন্তু বড়-দিদির কথা তিনি কিছুতেই অমান্য করিতে পারিতেন না, কাজেই সমস্ত তিরস্কার, অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করিতে হইত।
দিন কয়েক পূৰ্ব্বে কালাচাঁদের নিকট পত্র আসিল যে, তাহার শাশুড়ী অত্যন্ত পীড়িতা, বাঁচিবার আশা নাই; মন্দাকিনীকে তাঁহারা একবার লইয়া যাইতে চান। কালাচাঁদের তাহাতে কোন দিনই আপত্তি ছিল না——ও-পাপ বিদায় হইলেই সে বাঁচে। পূৰ্ব্বেও অনেকবার মন্দাকিনী পিত্রালয়ে গিয়াছেন; কিন্তু দুইমাস যাইতে না যাইতেই গোরাচাঁদ নিজে যাইয়া ভাদ্রবধূকে বাড়ী লইয়া আসিতেন; মন্দাকিনীর পিতা মাতা আপত্তি করিতে পারিতেন না। এবার শাশুড়ীর পীড়ার সংবাদ পাইয়া কালাচাঁদ শ্বশুর-বাড়ীতে পত্র লিখিয়া দিয়াছিল যে, তাঁহাদের যখন ইচ্ছা, তখনই মন্দাকিনীকে লইয়া যাইতে পারেন; তাহার কোনই আপত্তি নাই। এই পত্র পাইয়াই মন্দাকিনীর পিতা কন্যাকে লইয়া যাইবার জন্য লোক প্রেরণ করিলেন। মানদা মন্দাকিনীকে বারবার বলিয়া দিলেন যে, মাকে একটু সুস্থ দেখিলেই সে; ষেন চলিয়া আসে– “দেখ্ছ ত ভাই, আমি একেলা মানুষ, কথা বল্বার লোকটী নেই। তুই না থাক্লে আমার বড়ই কষ্ট হবে। এতদিন তবুও তিনি বেঁচে ছিলেন। এখন যে আমার সব দিক্ অন্ধকার। তুই থাক্লে কথায়-বাৰ্ত্তায় কাজে-কৰ্ম্মে দিনগুলো কেটে যায়। দেখিস্ ভাই, বেশী বিলম্ব করিস না।” মন্দাকিনী মানদার পদধূলি লইয়া বলিল “না দিদি, তোমাকে এমন একেলা ফেলে কি আমি সেখানে থাক্তে পারি; মাকে একটু ভাল দেখ্লেই আমি চলে আস্ব ।”