মহিম বলিল “ও কি কথা বল্ছ পিসিমা ! তুমি না হ’লে কি আমাদের চলে। কা’ল রাত্রিতেই যখন পাড়ার সকলে একত্র হলেন, তখন আমিই বলেছিলাম, এখনই শ্যামা পিসিকে খবর দেওয়া হোক্। তাতে সকলেই বল্লেন যে, বুড়ো মানুষ, এই সারাদিন খেটেখুটে সন্ধ্যার সময় ক্লান্ত হয়ে বাড়ী গিয়েছেন, এখন আর তাঁকে কষ্ট দিয়ে কাজ নেই। কা’ল সকালে তাঁকে ডেকে এনে একটা ব্যবস্থা করলেই হবে। তাইতেই ত তোমাকে তাঁরা ডাক্তে পাঠিয়েছেন।”
“হ্যাঁরে, শুন্লাম না কি বৌটাকে আর তার মেয়েটাকে রমা। নিয়ে গিয়েছে?”
মহিম বলিল “হ্যাঁ, আজ ভোরে তাঁরা চলে গিয়েছেন।” “চলে যদি গিয়ে থাকে, তোরা যদি যেতে দিয়ে থাকিস্, তা হ’লে এখন আবার তার ব্যবস্থা কি?”
“আমরা কি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আজ ভোরেই তাঁরা যাবেন । কা’ল রাত্রিতে ঐ রকম একটা কথা উঠেছিল, এই মাত্র। তাই যে হবে, তা আমরা জান্তাম না, বুঝতেও পারি নাই ।”
“তা হ’লে বল্, কাউকে জিজ্ঞাসা না করে চণ্ডী মুখুয্যে এই কাজ করেছে ? এর একটা ব্যবস্থা করা চাই। চণ্ডী মুখুয্যে কেমন ছেলে, তা দেখ্তে হবে । মনে করেছিলাম, এ সবের মধ্যে যাব না ; কিন্তু চণ্ডী মুখুয্যের এত বড় বাড় বাড়ন্ত কেমন করে হোলো, সেটা বুঝতে হবে। চল্, যাই দেখি।” এই বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী বাড়ীর দিক হইতে ফিরিয়া মুখুয্যে-পাড়ার দিকে চলিলেন। মহিম আর বাক্যব্যয় না করিয়া তাঁহার অনুগমন করিল।
০৭. চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে পৌঁছিয়া
চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে পৌঁছিয়াই শ্যামা ঠাকুরাণী দেখিলেন, পাড়ার অনেকেই সেখানে সমবেত হইয়াছেন। তিনি কোন প্রকার ভূমিকা না করিয়া একেবারে অতি কঠার স্বরে চণ্ডী বাবুকে আক্রমণ করিলেন; বলিলেন “আচ্ছা বলি চণ্ডীচরণ, তুমি এমনই কি গাঁয়ের মাতব্বর হয়ে বসেছ, যে কাউকে কিছু না বলে এমন কাজটা করে বস্লে।”
চণ্ডী বাবু বলিলেন “কৈ, আমি ত কিছুই করি নাই।”
“কর নাই? তোমার বোন বড় জমিদার, তা জানি; কিন্তু তাই ব’লে সে যে আমাদের গাঁয়ের এই কলঙ্কটা দশ গাঁয়ে ছড়িয়ে দিতে গেল, আর তুমি তাতে কথাটাও বল্লে না, এ কি ভাল হোলো ?”
চণ্ডী বাবু বলিলেন “আমি কেন তা করতে যাব? দিদি ওদের নিয়ে গেলেন, তাতে আমার হাত কি? আমি নিষেধ করবারই বা কে? তবুও এঁদের জিজ্ঞাসা কর, আমি আপত্তি করেছিলাম কি না।”
“তুমি আপত্তি কর্লে, আর তোমার বাড়ীর বৌকে মেয়েকে তারা জোর করে নিয়ে গেল! কাকে বোকা বোঝাও তুমি চণ্ডীচরণ! আমার বয়স এই ষাট পার হয়ে গেল; তোমাদের হাটহদ্দ সবই আমি জানি। তোমার দিদি বড়মানুষ আছেন, বেশ কথা । তিনি তাঁর নিজের দেশে, নিজের জমিদারীতে গিয়ে তাঁর ক্ষমতা দেখান। আমাদের গাঁয়ের বৌকে তিনি অমন করে নিয়ে যাবার কে? তাই বল ত শুনি? আর, তুমি এর ভিতর না থাক্লে, সে যতবড় লোকই হোক না কেন, এমন কাজ করতে পারে?”
ভট্টাচার্য্য মহাশয় দেখিলেন বেগতিক; তিনি বলিলেন “সে যা হবার তা হয়ে গিয়েছে; এখন এ অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার কি হবে, তাই বল। আমরাই কি জানি যে, তার। আজ ভোরেই ওদের নিয়ে চলে যাবে। কা’ল রাত্রে ঐ রকম একটা কথা হয়েছিল বটে; কিন্তু তার ত কোন মীমাংসাই হয় নাই। চণ্ডীর এ কাজটা যে গর্হিত হয়েছে, এ কথা বল্তেই হবে। তাদেরও বিবেচনা করা উচিত ছিল।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “সে ত ঠিক্ কথা। আমাদের গাঁয়ের বৌ দোষ-ঘাট করে থাকে, আমরাই তার শাস্তি দেব, আমরাই তার ব্যবস্থা করব; তারা কোথাকার কে যে, গাঁয়ের বৌকে এমন করে নিয়ে যায়। এতে যে তোমাদের একেবারে মাথা কাটা গেল, তা বুঝতে পেরেছ।”
একটী যুবক সেখানে দাঁড়াইয়া ছিল; তাহার আর সহ্য হইল না; সে বলিল “কাজটা অন্যায়ই বা কি হয়েছে? তোমরা ব্যবস্থা করলে, সেই বৌটাকে তাড়িয়ে দেবার। তাঁরা দয়া করে তাকে আশ্রয় দিয়ে নিয়ে গেলেন। এতে তাঁদের অপরাধটা কি হোলো।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “তাড়িয়ে দেবে না, কি মাথায় করে নাচ্বে। চুপ কর্, তোরা ছেলে-মানুষ, এ সব কথার তোরা কি বুঝবি। কত বড় অপমানটা হোলো জানিস্।”
যুবকও ছাড়িল না; বলিল “আর সেই নিরপরাধা বৌটীকে বাজারে দাঁড় করিয়ে দিলে ভারি আমাদের মান বাড়ত। যে অপরাধ করল, তার কোন শাস্তির কথা নেই, কথা হোলো কি না, যারা শত বিপদ, শত লাঞ্ছনার ভয় না করে, সেই অনাথাকে আশ্রয় দিল, তাদিকে কেমন করে নির্য্যাতন করা যায়, তারই ব্যবস্থা।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “জানিস্ নে, শুনিস্ নে; মাঝের থেকে মোড়োলী করতে আসিস্। এই যে শ্যামা বামণী দেখ্ছিস, এর কাছে কিছুই ছাপা নেই। ও বৌটা ঐ রকমই বজ্জাত ছিল। আমি আর কি না জানি; তবে গাঁয়ের বৌ, তাই এতদিন চাপা দিয়ে রেখেছিলাম। হয় না হয়, ঐ ত কালাচাঁদ বসে আছে, ওকে জিজ্ঞাসা কর্। আসল কথা ত জানিস্নে এতকাল গেল, কালাচাঁদ কিছু করল না; আর কা’ল রাত্তিরে, পাশের বাড়ীতে দশ গাঁয়ের লোক জমা, সেই সময় বৌকে আক্রমণ করতে গেল; এও কি বিশ্বাসের কথা।”
আর একটা যুবক বলিল “সে কি কথা পিসিঠাকরুণ, আমরা যে সেখানে উপস্থিত ছিলাম, আমরা যে স্বচক্ষে দেখেছি।”
“ছাই দেখেছিস্। আসল কথা ত তোরা বুঝলিনে। আমি শোনা মাত্র ওসব বুঝে নিয়েছি; আর আমি সবই জানি কি না। হয় না হয় জিজ্ঞাসা কর ঐ কালাচাঁদকে।”