শ্যামা ঠাকরুণ বলিলেন “এই যে তারা সে-দিন দশ টাকা নিয়ে গেছে; আবার আজ টাকা। দশ দশ টাকা; কি করে শোধ দেবে। তোমরা যে টাকা দিয়ে কি কর, তা বুঝতে পারি নে। আর আমারই কি ন-শ পঞ্চাশ আছে যে, যার যখন দরকার পড়বে, তখনই কুলোবো। এখন তাড়াতাড়ি, আর কথা বল্তে পারছিনে। তুমি আর যেও না, তারাকেই ও-বেলা পাঠিয়ে দিও। দেখ্ব, কি করতে পারি।”
তারার পিসি বলিল “আর করা-করি নয় দিদি ঠাকরুণ, এ দায়টা তোমার উদ্ধার করে দিতেই হবে। তুমি না হলে আমাদের এ গরিবদের দুঃখু আর কে বোঝে বল। তা যাও, আর দেরী করো না। মুখুয্যেদের যে এমন ব্যাভার, তা এতদিন জানতাম না।”
শ্যামা ঠাকুরাণী এ কথার কোন উত্তর না দিয়াই অগ্রসর হইলেন। একটু যাইতেই রাস্তার বাম পার্শ্বে রামতারক ভট্টাচার্যোর বাড়ী। শ্যামা ঠাকুরাণীর মনে পড়িল, তারকের ছেলেকে ত কাল দেখা হয় নাই। অমনি রাস্তা ছাড়িয়া তিনি ভট্টাচার্য্য বাড়ীর দিকে গেলেন। বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া উঠানে দাঁড়াইয়াই বলিলেন “ওগো বৌমা, ছেলেটা কা’ল কেমন ছিল? কা’ল আর আসতে পারি নি; সারাদিনটা মুখুয্যে বাড়ীর ব্যাপারে ছিলাম; ছেলেটার কথা আর মনে হয় নাই। নিয়ে এস ত দেখি? কা’ল ক’বার দাস্ত হয়েছিল?”
রামতারকের স্ত্রী তাড়াতাড়ি ছেলে কোলে লইয়া উঠানে আসিয়া বলিল “কা’ল একটু ভালই ছিল। পেটের বেদনাও একটু কম, দাস্তও এই পাঁচ ছয়বার হয়েছিল। তা মা, আসন এনে দিই, একটু বোসো।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “না মা, আমার কি বস্বার সময় আছে। ভয় নেই, আমাশয় কি না, সারতে একটু সময় নেবে। ঐ যে শিকড় তোমাকে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছি, আজও তারই রস একটু আদার রসের সঙ্গে খাইয়ে দিও। আর দুই-একদিন সাবধানে রেখো, ছেলে সেরে উঠ্বে। কোন অত্যাচার করে না বৌমা! কৈ, তারক কৈ? তাকে ত দেখ্ছিনে?
তারকের স্ত্রী বলিল “সকালে উঠেই তিনি মুখুয্যে-বাড়ী গিয়েছেন। হ্যাঁ মা, মুখুয্যে-বাড়ী কি হয়েছে? ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে উনি বল্লেন, সে সব শুনে কাজ নেই। কোন খুন-খরাবৎ হয় নি ত!”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “বৌমা, সে সব কথা আর তোমার শুনে কাজ নেই। তোমরা বৌ-মানুষ, সে কথা শুন্লে লজ্জায় তোমাদের মাথা হেঁট হবে। আশীর্ব্বাদ করি, স্বামীপুত্র নিয়ে সুখে থাক, পরের কথার মধ্যে যেও না।”
তারকের স্ত্রী তখন নতজানু হইয়া শ্যামা ঠাকুরাণীর পদধূলি লইয়া প্রথমে ছেলের মাথায় দিল, তাহার পর নিজের মাথায় লইয়া বলিল “সেই আশীর্ব্বাদই কর মা ! তাই যেন হয়। ফিরে যাবার সময় আর একবার থোকাকে দেখে যাবে ত । আমি এখনই ওষুধ এনে খাইয়ে দিচ্ছি।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আর ত ভয়ের কিছু নেই। দেখি, ফিরবার সময় যদি পারি ত একবার খোঁজ নিয়ে যাব । আমার কি মা, সোয়াস্তি আছে, না অবসর আছে। এই গায়ের দশ তাল নিয়েই আমি আছি।”
তারকের স্ত্রী বলিল, “তাই থাক মা, তাই থাক। তুমি আছ, তাই বিপদ-আপদে ভয় হয় না; ডাক্লেই তুমি এসে উপস্থিত হও। কত যে বল ভরসা তোমার করি মা, তা এক মুখে বল্তে পারিনে৷”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আর দেরী করতে পারছিনে। দেরী করে গেলে সবাই একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠ্বে। তাই দেখ বাছা, তোরা আছিস্ গ্রামের পুরুষ-মানুষ; তোরা লেখাপড়া জানিস; তোদেরও বুদ্ধি-বিবেচনা আছে; কিন্তু যে কাজটী পড়বে, অমনি ডাক্ এই শ্যামা বামণীকে। এক কাল ছিল, যখন এসব পেরে উঠতাম; এখন বয়সও হয়েছে, এখন কোথায় বসে ঠাকুর দেবতার নাম করব, না কে কোন্ মুখুয্যে তার ভাই বৌয়ের উপর অত্যাচার করল, এখন চললাম তার সালিস্ করতে।”
তারকের স্ত্রী বলিল “তা হলে কথাটা সত্যি না কি? ও মা, কি ঘেন্না, কি লজ্জা! আমি অমনি একটু আভাস পেয়েছিলাম। তা যাক্গে, তুমি ঠিক্ বলেছ, ও-সব লজ্জার কথা, কলঙ্কের কথা গেরস্তর বৌদের না শোনাই ভাল! কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাক্বে মা, তাড়াতাড়ি যদি না থাকে ত আসন এনে দিই, একটু বোসো।”
“না, না, আর বস্বার সময় নেই” বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী ভট্টাচার্য্য-বাড়ী হইতে বাহির হইলেন। সদর রাস্তায় উঠিবার সময়ই দেখিলেন, মুখুয্যেপাড়ার দিক হইতে হরিশ গাঙ্গুলীর ছেলে মহিম আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়াই শ্যামা ঠাকুরাণী রাস্তার পার্শ্বে ই দাঁড়াইলেন। মহিম তাঁহাকে দূর হইতেই দেখিয়াই একটু দ্রুতগতিতে আসিয়া বলিল “পিসিমা, আমি যে তোমার বাড়ীতেই যাচ্ছিলাম।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “আমার বাড়ীতে! কেন, তোর কিছু দরকার আছে না কি?” এই বলিয়াই তিনি নিজের বাড়ীর দিকে মুখ ফিরাইলেন, যেন বাড়ীর দিকেই যাইবেন।
মহিম বলিল “বাবা পাঠিয়ে দিলেন তোমাকে ডাক্তে । এখনই একবার চণ্ডী বাবুর বাড়ীতে যেতে হবে। পাড়ার সকলেই তোমার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছেন।”
শ্যামা ঠাকুরাণী একটু অভিমানের সুরে বলিলেন “আমার জন্য অপেক্ষা, কেন ? আমি গরিব বামুণের বিধবা মানুষ; গায়ের এক কোণে পড়ে আছি; আমার আর তত্ত্বতলাসের দরকার কি? হাঁ, যদি রমার মত জমিদার হতাম, তা হোলে তোরাই দিনের মধ্যে পচিশ-বার খোজ নিতি। বল্গে যা, আমার এখন সময় নেই। আমার যাবারই বা দরকার কি ? তারকের ছেলেটার অসুখ, তাই দেখ্তে এসেছিলাম। আমি যেতে পাচ্ছিনে। তোরাই আছিস্, তোরাই এখন গাঁয়ের প্রধান হয়েছিস্। তোরাই যা হয় কর গিয়ে, আমার খোজ কেন?” এই বলিয়া শ্যামা ঠাকুরাণী নিজ গৃহের দিকে দুই তিন পা বাড়াইলেন।