শ্যামা ঠাকুরাণী বলিলেন “হ্যাঁ ভাই, কাল বড় খাটুনী গিয়াছে। বুড়ো বয়স, এখন আর অত পরিশ্রম সহ্য হয় না, তাই আজ সকালে উঠতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছে। তা, কি বলছিলে,ঐ রাতের খবর! কৈ না, আমি ত কিছুই জানিনে।”
“সে কি কথা, এমন একটা ব্যাপার হয়ে গেল, আর তুমি জান না।”
শ্যামা ঠাকুরাণী বিস্মিত হইয়া বলিলেন “না, আমি কোন খবরই পাই নি। কি, হয়েছে কি?”
“হবে আর কি? গাঁময় একেবারে ঢি ঢি পড়ে গেছে। ওপাড়ার কালু মুখুয্যে না কি রাত্তিরে তার ভাই-বৌকে বেইজ্জত করেছে। তাই নিয়ে একেবারে কুরুক্ষেত্তর কাণ্ড! চণ্ডী মুখুয্যের বোন সুন্দরী ঠাকুরাণী ওদের ছেলের ভাতে এসেছিল কি না। সে না কি আজ সকালেই গোরা মুখুয্যের বৌ আর তার মেয়েকে নিয়ে চলে গেছে।”
শ্যামা ঠাকুরাণী উগ্রভাবে বলিলেন “কি বলিস্, এত বড় কাণ্ড হয়ে গেল, আর আমি খবরটাও পেলুম না, আমাকে কেউ কথাটাও জিজ্ঞাসা করল না। না, তুই হয় ত শুন্তে ভুল করেছিস্। তাও কি কখন হয় ?”
“আমি কি আর না জেনে-শুনেই কথা বল্ছি। আমার ছেলে যে কাল রাত্রিতে মুখুয্যে-বাড়ীতেই ছিল। সে আর ঐ গোলমালে বাড়ী আস্তেই পারে নাই। এই সকাল বেলা এসে সব কথা বল্ল। তারা নৌকা ছেড়ে দিয়ে চলে গেলে তবে ত আমার ছেলে বাড়ী এসেছে।”
শ্যামা ঠাকুরাণী রাগে, অভিমানে একেবারে জ্বলিয়া উঠিলেন। কি, এত বড় কথা! এখনও তিনি মরেন নাই; ইহারই মধ্যে এমন অশ্রদ্ধা! তাঁহাকে না জানাইয়াই ও-পাড়ার লোকেরা এত বড় কাজটা করিয়া ফেলিল। তিনি তখন ক্রোধভরে বলিলেন “বেশ, যার যা ইচ্ছে, সে তাই করুক গে! শ্যামা বামণী এ গাঁয়ের আর কাহার কোন কথার মধ্যে নেই। কি বেইমান গো, এই গাঁয়ের লোকগুলো! এই যে এতদিন দিন নেই, রাত নেই, যে যখন বিপদে পড়েছে, যার যখন দরকার পড়েছে, তখনই এই শ্যামা বামণী না খেয়ে না দেয়ে একেবারে বুক দিয়ে পড়েছে, এ বুঝি তারই ফল। যাক্ আমি আর কারো কিছুর মধ্যে নেই। কারও বাড়ীও যাব না, কারও কোন কথাতেও থাক্ব না। আমি কি কারও খাই না ধারি যে, যে ডাক্বে তার বাড়ী যাবো। আজ থেকে নাকে-কাণে খত দিচ্ছি হরির মা! আমার পায়ে এসে মাথা খুঁড়লেও কারও উপকার করছিনে। এত হেনেস্তা, এমন অপমান৷” শ্যামা ঠাকুরাণী এই বলিয়াই ঘরের মধ্যে চলিয়া গেলেন; হরি সরকারের মা প্রাঙ্গণে একটু দাঁড়াইয়া থাকিয়া আপন কাজে চলিয়া গেল।
শ্যামা ঠাকুরাণীর রাগও হইল, অভিমানও হইল; কিন্তু এত বড় একটা ব্যাপারে তাঁহাকে না ডাকিয়া, তাঁহার সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া যে গ্রামের সকলে একটা কাজ করিয়া বসিল, ইহাতে মুখে তিনি যতই উপেক্ষা প্রদর্শন করুন না কেন, তাঁহার মনে কিন্তু বড়ই বাজিল। গ্রামের মধ্যে তাঁহার যে একাধিপত্য ছিল, তাহা এক কথায় ছাড়িয়া দিতে ত তিনি পারেন না; তাহা হইলে যে তিনি একেবারে দশজনের একজন হইয়া পড়িবেন; ভবিষ্যতে যে কেহই তাঁহাকে মানিবে না। সুতরাং এমন করিয়া সমস্ত সম্পর্ক ছাড়িয়া দিয়া সুবর্ণপুরে বাস করা তাঁহার পক্ষে একেবারে যে অসম্ভব। গ্রামের দশজনের দশ কথা, দশ ব্যাপার লইয়াই যে তিনি জীবনের এই সুদীর্ঘকাল কাটাইয়াছেন। তাঁহার আর গৃহকর্ম্ম এমন কি? বিধবা ব্রাহ্মণ-কন্যার এক বেলার দুটা হবিষ্যি, তার জন্য ত আর সারা দিন-রাত দরকার হয় না; জোতজমা ও খাতক লইয়াই বা কতক্ষণ সময় কাটে?
শ্যামা ঠাকুরাণী ঘরের মধ্যে যাইয়া এটা ওটা নাড়াচাড়া করেন, আর ঐ কথাই তাঁহার মনে হয়। তাই ত, এতদিন না ততদিন, গ্রামের লোক তাঁহাকে এতবড় কাণ্ড সম্বন্ধে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করিল না। একবার ভাবিলেন, কাজ নাই, চুপ করিয়াই থাকিবেন; কিছুর মধ্যেই যাইবেন না; কিন্তু পরক্ষণেই মনে হইল, না, সে কিছুতেই হইতে পারে না। কথাটার বৃত্তান্ত তাঁহার জানিতেই হইতেছে। তখন আর তিনি ঘরে থাকিতে পারিলেন না; কাজকর্ম্ম আর করা হইল না; বাসি কাজ পড়িয়াই রহিল। তিনি ঘরে তালা বন্ধ করিয়া বাহির হইলেন।
রাস্তা দিয়া যাইতে ও-বাড়ীর তারার পিসি তাহার উঠান হইতে বলিল “কি গো দিদি ঠাকরুণ, মুখুয্যে বাড়ী যাচ্ছ বুঝি। তা তুমি না গেলে চলবে কেন? বাবা গো, এমন কথা ত কখন শুনিনি দিদি! তুমি গাঁয়ে আছ, কা’ল রাত্তিরেই মিটিয়ে দিতে পার নেই। আজ আবার শুনলাম, মাগীটা না কি গাঁ ছেড়ে গিয়েছে ? হ্যাঁ দিদি ঠাকরুণ, তুমি গায়ে থাক্তে এক গাঁয়ের কলঙ্ক আর এক গাঁয়ে যেতে দিলে। তা যাই বল না, এ কাজটা তোমার ভাল হয় নাই ।”
শ্যামা ঠাকুরাণী আত্ম-প্রতিষ্ঠা অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য বলিলেন “তা কি করি বল বোন! রমা আমার ত পর নয়। তার সঙ্গে আমার যে ভাব, সে আমাকে যে রকম ভালবাসে, তাতে তার কথাও ফেলে দেওয়া যায় না। তাইতে বুঝলে বোন! ছেড়ে দিতে হোল। এখন যাই দেখি, সব মিটিয়ে দিয়ে আসি। এ গায়ের কোন কাজেই ত এই শ্যামা বামণী না হলে চলে না।”
তারার পিসি বলল “সে কি আর বল্তে দিদি ঠাকরুণ, তুমি আছ বলেই আমাদের এই গাঁটা ঠিক আছে, নইলে এতদিন কি কেউ গাঁয়ে বাস করতে পারত। তা হ্যাঁ দেখ, ও-বেলা তোমার ওখানে যাব মনে করেছিলাম। তা এখনই দেখা হয়ে গেল, এখনই কথাটা বলি। তারা বল্ছিল পিসিমা, হাতে ত টাকা নেই, জমিদারের খাজনা তিন টাকা দুই-এক,দিনের মধ্যেই দিতে হবে। তুমি যদি বামুনঠাকরুণের কাছ থেকে ধার করে এনে দাও। তাই তোমার কাছে যেতে চেয়েছিলাম। পথেই দেখা হোলো। ও-বেলা কখন যাব দিদিঠাকরুণ!”