সাধারণত সকলে ঋগ্বেদের পুরুষসূক্তকেই (১০ম মণ্ডল, ৯০ সূক্ত) এই বর্ণভেদের মূল মনে করেন। তাহাতে দেখা যায়,
ব্রাহ্মনোহস্য মুখমাসীদ বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
উরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।। —ঋগ্বেদ, ১০.৯০.১২
অর্থাৎ, “সেই প্রজাপতির মুখ হইল ব্রাহ্মণ, বাহু হইল রাজন্য অর্থাৎ ক্ষত্রিয়, ইঁহার উরু হইল বৈশ্য এবং পদদ্বয় হইতে জন্মিল শূদ্র।” ইহাতে দেখা যায় জাতি লইয়াই মানুষ সৃষ্ট হইল। ঋগ্বেদে ব্রাহ্মণ শব্দ খুবই বিরল, তাহাও জ্ঞানী বা পুরোহিত অর্থে ব্যবহৃত। ক্ষত্রিয় শব্দও বড় একটা দেখা যায় না। বৈশ্য ও শূদ্রের উল্লেখ দেখা যায় মাত্র পুরুষসূক্তের ঐ শ্লোকটিতেই।
এখন পণ্ডিতদের মতে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল অনেকটা অর্বাচীন অর্থাৎ আধুনিক। তাহাতে দেখা যায় মাত্র চারিটি বর্ণ। তাহার দ্বারা আমাদের দেশের অসংখ্য জাতিবিভাগের মীমাংসা হয় কেমন করিয়া? মুখে আমরা চাতুর্বর্ণ্য বলিলে কি হইবে? সেন্সস দেখিলে দেখা যায় জাতি তো প্রায় চারি হাজার, তাহার মধ্যেও ভেদ-বিভেদের অন্ত নাই।
চারি বর্ণের উৎপত্তি সম্বন্ধে এই যে সংশয় ও মতভেদ ইহা সেই যুগেও ছিল। প্রাচীনকালেও পুরুষসূক্তের এই মত সকলে মানিয়া লইতে পারেন নাই। বিষ্ণুপুরাণ আর এক স্থানে বলেন, “ভার্গ হইতে ভার্গভূমি পুত্র হইলেন। তাঁহা হইতেই চাতুর্বর্ণ্য প্রবর্তিত হইল।”
ভার্গস্য ভার্গভূমিঃ, অতশ্চাতুবর্ণ্যপ্রবৃত্তিঃ।। —বিষ্ণুপুরাণ, ৪র্থ অংশ, ৮, ৯
দক্ষ প্রজাপতি ব্রহ্মার দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ হইতে জাত।
ব্রহ্মণশ্চ দক্ষিণাঙ্গুষ্ঠজন্মা দক্ষপ্রজাপতিঃ।। —বিষ্ণুপুরাণ, ৪, ১, ৫
মহাভারতে দেখি আদি সৃষ্টির কথা কহিতে গিয়া জনমেজয়কে বৈশম্পায়ন বলিতেছেন, “ব্রহ্মার ছয়টি মানসপুত্র, মরীচি অত্রি অঙ্গিরা পুলস্ত্য পুলহ ক্রতু। মরীচির পুত্র কশ্যপ, কশ্যপ হইতে এই সব প্রজা সৃষ্ট।”
ব্রহ্মণো মানসাঃ পুত্রা বিদিতাঃ ষন্মহর্ষযঃ।
মরীচিরত্র্যঙ্গিরসৌ পুলস্ত্যঃ পুলহঃ ক্রতুঃ।
মরীচেঃ কশ্যপঃ পুত্রঃ কশ্যাপাৎ তু ইমাঃ প্রজাঃ।। –আদিপর্ব, ৬৫, ১০-১১
ব্রহ্মার মানসপুত্রদের কথা সকল পুরাণেই আছে। তাঁহাদের সন্ততিই তো ব্রাহ্মণেরা। ব্রহ্মার বরুণযাগের অগ্নি হইতে ভৃগুর জন্ম, তাহার পর চলিল তাঁহার সন্ততিধারা (আদিপর্ব, ৫, ৭-৮)।
গীতাতে তো দেখি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন, “চাতুর্বণ্য আমি সৃষ্টি করিয়েছে গুণকর্মানুসারে।”
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।।–৪, ১৩
বিষ্ণুপুরাণের মতে গৃৎসমদের পুত্র শৌনকই চাতুর্বর্ণ্য প্রবর্তিত করেন।
গৃৎসমদস্য শৌনকশ্চাতুর্বর্ণ্যপ্রবর্তয়িতাভূত।।–বিষ্ণুপুরাণ, অংশ ৪. ৮, ১০
হরিবংশও বলেন, “শুনক হইলেন গৃৎসমদের পুত্র। শুনক হইতে শৌনক নামে পরিচিত ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র জাতীয় বহু পুত্র জন্মে।”
পুত্রো গৃৎসমদস্যাপি শুনকো যস্য শৌনকাঃ।
ব্রাহ্মণাঃ ক্ষত্রিয়াশ্চৈব বৈশ্যাঃ শূদ্রাস্তথৈব চ।।–২৯ অধ্যায়, ১৫১৯-২০
এই হরিবংশেই আর একটি মতেরও উল্লেখ দেখা যায়। শিবির সন্তান রাজা বলিকে ব্রহ্মা বর দেন, “তুমি বর্ণচতুষ্টয়ের স্থাপয়িতা হইবে।”
চতুরো নিয়তান্ বর্ণান্ ত্বং চ স্থাপয়িতেতি হ।।–ঐ ৩১, ১৬৮৮
হরিবংশে আরও একটি মতের কথা জানা যায়। “অক্ষয় হইতে ব্রাহ্মণেরা, ক্ষর হইতে ক্ষত্রিয়েরা, বিকার হইতে বৈশ্যেরা, ধূমবিকার হইতে শূদ্রেরা উৎপন্ন।
অক্ষরাদ্ ব্রহ্মণাঃ সৌম্যাঃ ক্ষরাৎ ক্ষত্রিয়বান্ধবাঃ।
বৈশ্যা বিকারতশ্চৈব শূদ্রা ধূমবিকারতঃ।।–হরিবংশ, ভবিষ্য পর্ব, ২১০, ১১৮১৬
নানাপুরাণে সৃষ্টিকথা নানাভাবে বর্ণিত। এখানে সকলগুলির উল্লেখ করা সম্ভব নহে। তবু আরও দুই-একটা কথার উল্লেখ করা যাইতেছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখি
ব্রহ্ম বা উদমগ্র আসীদ্ একমেব তদেক্যসন্ ন ব্যভবৎ তচ্ছ্রেয়োরূপম্ অত্যসৃজত ক্ষত্রম্।–১, ৪, ১১
একমাত্র এই ব্রহ্মই অগ্রে ছিলেন, একা বলিয়া তিনি বৈভবহীন ছিলেন, তাই তিনি শ্রেয়োরূপ ক্ষত্রিয়কে সৃষ্টি করিলেন। এখানে প্রথমে ক্ষত্রিয়সৃষ্টির কথাই পাইতেছি।
মহাভারতে শান্তিপর্বে অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলিতেছেন “দেবদেব বরপ্রদ নারায়ণের বাকুসংযমকালে তাঁহার মুখ হইতে ব্রাহ্মণেরা প্রথমে প্রাদুর্ভূত হইলেন। পরে ব্রাহ্মণ হইতে অন্যান্য বর্ণ প্রাদুর্ভূত হইল।”
বাক্যসংযমকালে হি তস্য বরপ্রদস্য দেবদেবস্য ব্রাহ্মণাঃ প্রথমং প্রাদুর্ভুতা ব্রাহ্মণেভ্যশ্চ শেষা বর্ণাং প্রাদুর্ভূতাঃ।।–মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৩৪২, ২১
তাহার পরে দেখা যায় যেহেতু ব্রাহ্মণ হইতেই অন্য তিনটি বর্ণ সৃষ্ট তাই তাহারাও ব্রাহ্মণের জ্ঞাতির স্বরূপ।
তস্মাদ্বর্ণা ঋভবো জ্ঞাতিবর্ণাঃ
সাংসৃজ্যন্তে তস্য বিকার এব।।–মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৬০, ৪৭
এখানে টীকাকার নীলকণ্ঠ বলিতেছেন, “যেহেতু তিন বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণই যজ্ঞস্রষ্টা, তাই তাহা হইতে জাত সকল বর্ণই যজ্ঞসংযোগবশতঃ ঋজু অর্থাৎ সাধু।”
যস্মাৎ ত্রিষু বর্ণেষু ব্রাহ্মণো যজ্ঞস্রষ্টা তস্মাত সর্বেহপি বর্ণা ঋজবঃ এব যজ্ঞসংযোগাৎ। (তত্র টীকা)
মহর্ষি জৈমিনিও বলেন, “চতুর্মুখ ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রারম্ভে অগ্রে ব্রাহ্মণগনকেই সৃজন করিয়াছিলেন, পশ্চাৎ পৃথক পৃথক সমস্ত বর্ণ তাঁহাদেরই বংশে উৎপন্ন হইয়াছে।”
সসর্জ ব্রাহ্মণানগ্রে স্ররষ্ট্যাদৌ স চতুমুখঃ।
সর্বে বর্ণাঃ পৃথক পশ্চাৎ তেষাং বংশেষু জজ্ঞিরে।।–পদ্মপুরাণ, উৎকলখণ্ড, ৩৮, ৪৪