এই বিষয়েরই আলোচনা এখানে যথাসাধ্য করিবার চেষ্টা করা যাইবে। আমরা সাধারণত প্রাচীন শাস্ত্র অর্থাৎ বেদ পুরাণ স্মৃতি প্রভৃতির উপরই আমাদের আলোচনাকে প্রতিষ্ঠিত রাখিব। দেশপ্রচলিত প্রথা ও আচারের আলোচনাও বাধ্য হইয়া করিতে হইবে। এইরূপ আলোচনায় সব সিদ্ধন্তই যে পরম ও চরম সত্য হইবে তাহা না-ও হইতে পারে। ভুলভ্রান্তিও থাকিতে পারে। তবু এই বিষয়ে যদি কাহারও কাহারও বিচার ও বিতর্ক জাগ্রত হয় তবেই শ্রম সার্থক মনে করিব। ভারতীয় জাতিভেদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ ইতিপূর্বে অনেক অনেক কাজ করিয়াছেন। আমি ঠিক সেই পথে কাজ করি নাই। তবু যখন আমার পূর্ববর্তী কাঁহারও ক্ষেত্রের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি তখন তাঁহাদের নাম করিয়াছি। এইরূপে কেতকর, উইলসন, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রিজলী, ক্রূক প্রভৃতি সেন্সসরিপোর্ট, ক্যাম্পবেল, ঘুরে প্রভৃতির নাম করিয়াছি। ডাক্তার G. SSS. Ghurye প্রণীত ‘Caste and Race in India’ পুস্তকখানি খুব উপাদেয়। তাহার অন্তভাগে এই বিষয়ে বহু বিশেষজ্ঞের নাম ও তাঁহাদের গ্রন্থের উল্লেখ আছে। তাহা দেখিলে অনেকেই উপকৃত হইবেন।
——————————-
১. Capt. N. A. Williard, Music of Hindusthan, intro : p.18
২. Encylopedia of Religion and Ethics VIII p.375
৩. Tribes and Castes of the NN. W. P and Frontier Provinces, vol. I, XVIXVI
ভারতের জাতিভেদ
ভারতে জাতিভেদের কথা বলিতে গেলেই প্রথমে জাতি কথাটার একটা সংজ্ঞা দেওয়া উচিত। জাতি জিনিসটা কি তাহা এই দেশে আমরা সবাই বুঝি। তাই বলিয়া ভাষাতে তাহার একটা সংজ্ঞানির্দেশ করা সহজ নহে। যুরোপীয় পণ্ডিতেরা নানা ভাবে এই বিষয়টা বুঝাইতে গিয়া অনেক সময় হার মানিয়াছেন। এদেশে জাতি জন্মগত। জাতির বাহিরে বিবাহ নিষিদ্ধ। মৃত্যুর পরে শবসৎকার এবং জীবিত থাকিতে আহারাদি, স্বজাতির মধ্যেই এতকাল সীমাবদ্ধ ছিল। এমন শহরে বাস, বিদেশ ভ্রমণ, হোটেল-রেস্টরাণ্ট প্রভৃতির ফলে এবং নূতন শিক্ষাদীক্ষার প্রভাবে আহারাদিগত আচারবিচার ক্রমে শিথিল হইয়া আসিতেছে।
এদেশে উচ্চতম জাতি ব্রাহ্মণ। তাঁহাদের মধ্যেও উচ্চনীচ অসংখ্য ভেদ। প্রদেশগত ভেদও গণনার অতীত। তাই ব্রাহ্মণদের মধ্যে কোন শ্রেণী উচ্চতম তাহা বলা অসম্ভব। বহু প্রদেশের বহু শ্রেণীর ব্রাহ্মণই সর্বোচ্চতার দাবি করেন। নিম্নতম জাতি যে কী তাহাও বলা কঠিন। এই উভয় কোটির মধ্যে স্তরের আর অন্ত নাই।
যে-সব জাতির জল ব্রাহ্মণাদি উচ্চ জাতির লোকেরা ব্যবহার করেন তাহারা জল-আচরণীয় অর্থাৎ ভালো জাতি। যাহাদের দেওয়া ঘৃতপক্ক খাদ্য ও মিষ্টান্ন ব্রাহ্মণেরা গ্রহণ করেন তাহারা আরও ভালো জাতি। সাধারণ স্বশ্রেণীর লোকের হাতে ছাড়া কাহারও হাতে ভাত ডাল বা রুটি ব্রাহ্মণেরা খান না।
দক্ষিণ-ভারতে স্পর্শবিচার আরও প্রবল। সেখানে যাহাদের স্পর্শে ব্রাহ্মণেরা অশুচি হন না ও যাহাদের জন ব্রাহ্মণের আচরণীয় তাহারাই ভালো জাতি। যাহাদের জন ব্রাহ্মণীরাও আচরণ করিতে পারেন তাহারা আরও ভালো জাতি। যাহাদের স্পর্শে ও জলে ব্রাহ্মণ বিধবারও অশুচিত্ব ঘটে না তাহারা তদপেক্ষা ভালো জাতি।
নীচ জাতির জল অনাচরণীয়, তাহাদের স্পর্শে অশুচিত্ব ঘটে। যাহাদের স্পর্শে মৃৎপাত্রও অশুচি হয় তাহারা আরও নীচ জাতি। যাহাদের স্পর্শে ধাতুপাত্র পর্যন্ত অশুচি হয় তাহাদের স্থান আরও নীচ। ইহাদের অপেক্ষাও যাহাদের জাতি নীচ তাহারা মন্দিরপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করিলেও মন্দির অশুচি হয়। কোনো কোনো জাতি গ্রাম বা নগরে প্রবেশ করিলে গোটা গ্রাম বা নগরই অশুচি হয়। এই সব বিষয়ের বিচার শ্রীযুক্ত শ্রীধর কেতকর মহাশয় তাঁহার রচিত ‘The History of Caste in India’ নামক পুস্তকে ভালো করিয়া করিয়াছেন (পৃ. ২৪, ২৫)।
এখনকার দিনে এই সব ছোঁয়াছুঁই ব্যাপারে অনেক স্থলে লোকের মতামতের অনেকখানি নড়চড় দেখা দিয়াছে। যাঁহারা ভাগ্যক্রমে উচ্চজাতির মধ্যে জন্মিয়াছেন তাঁহারাও অনেক সময় এতটা বাছবিচার পছন্দ করেন না, আর যাঁহারা দুর্ভাগ্যক্রমে তথাকথিত নীচজাতির মধ্যে জন্মিয়াছেন তাঁহারাও আর নিজেকে একেবারে হীন বা পতিত বলিয়া মানিয়া লইতে রাজি নহেন এবং উচ্চপক্ষীয়দের সমকক্ষতা দাবি করেন। নীচজাতির মধ্যে এখনও কিন্তু অনেক সময়েই নীচতর জাতিকে দাবাইয়া রাখিবার প্রয়াসটি রীতিমতই দেখা যায়।
উচ্চতর জাতীয় লোকেরা অনেকেই এখনো বর্ণাশ্রমব্যবস্থাকে ভালোই বলেন। স্বামী দয়ানন্দ বলেন, “ভারতের এই অসংখ্য জাতিভেদের স্থলে মাত্র চারিটি জাতি থাকুক, সেই চাতুর্বর্ণ্যও নির্ণিত হউক গুণকর্মের দ্বারা। বেদের অধিকার হইতে কোনো বর্ণই বঞ্চিত না হউক।”
মহাত্মা গান্ধী অস্পৃশ্যতার বিরোধী কিন্তু তিনি বর্ণাশ্রমের বিরোধী নহেন। শ্রীযুক্ত লক্ষ্মী নরসু ‘A Study of Caste’ নামক পুস্তকে মহাত্মাজীর কিছু মত উদ্ধৃত করিয়াছেন (P. 131)। তাহাতে দেখা যায় মহাত্মাজী বলেন, “Varnashrama is inherent in human nature, and Hinduism has reduced it to a science. It does attach by birth. A man cannot charge his Varna by choice.” অর্থাৎ, “বর্ণাশ্রম মানুষের স্বভাবনিহিত, হিন্দুধর্ম তাহাকেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। জন্মের দ্বারা বর্ণ নির্ণীত, ইচ্ছা করিলেও ইহার ব্যত্যয় ঘটিতে পারে না।” দেখা গেল এই বর্ণভেদ জন্মগত। ব্রাহ্মণ হইতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় হইতে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য হইতে বৈশ্য, শূদ্র হইতে শূদ্র উৎপন্ন। এখন এই ভেদের মূল কোথায়?