আফসার সাহেবের চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল। ইসহাক সাহেব বললেনবিড়ালের কথা বুঝতে পারেন বলে যা শুনছি তা কি সত্যি?
জ্বি স্যার, সত্যি!
আই সি, ভেরি ইন্টারেষ্টিং। শুধু কি বিড়ালের কথাই বুঝতে পারেন, না কুকুর, গরু, গাধা, ভেড়া, ছাগল-সবার কথাই বুঝতে পারেন?
বিড়ালের ব্যাপারটা জানি। অন্যগুলি পরীক্ষা করে দেখি নি।
আপনি একটা কাজ করুন না কেন? খাতা এবং পেনসিল নিয়ে চিড়িয়াখানায় চলে যান। যে-সব প্রাণীর কথা। আপনি বুঝতে পারেন তাদের নামের বিপরীতে একটা করে টিক চিহ্ন দিন। আমার ধারণা, বিড়ালের কথা যখন বুঝতে পারছেন অন্যদেরটাও ইনশাআল্লাহ্ পারবেন।
আফসার সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, স্যার, আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?
সরি-তা একটু ঠাট্টা অবশ্যি করেছি। ক্ষমা করবেন। আমি যদি বলতাম বিড়ালের কথা বুঝতে পারছি, তাহলে আপনিও আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করতেন।
না, আমি করতাম না।
হয়তো-বা করতেন না। যাই হোক, আমি করে ফেলেছি। তার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি। আপনি এক কাজ করুন-অফিস থেকে দিন দশেকের ছুটি নিন।
আমার ছুটির প্রয়োজন নেই।
আমার মনে হয় প্রয়োজন আছে। আপনি ছুটি নিন। সাইকিয়াটিস্টকে দিয়ে ভালোমতো চিকিৎসা করান, নয়তো কিছুদিন পর বলা শুরু করবেন-আপনি পিঁপড়ার কথাও বুঝতে পারছেন। আমি ছুটির ব্যবস্থা করে রেখেছি। যদি চান আমি কয়েক জন সাইকিয়াটিক্টের ঠিকানাও আপনাকে দিতে পারি।
আমি স্যার তার কোনো প্রয়োজন বোধ করছি না।
আপনি হয়তো করছেন না, আমি করছি! আমি এমন কাউকে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিতে পারি না, যে পশুদের কথা বুঝতে পারে। আমার এমন অফিসার দরকার, যে মানুষের কথা বুঝতে পারবে। আমি লক্ষ করেছি, আমাদের মধ্যে বেশির ভাগই মানুষের কথা বুঝতে পারি না।
আফসার সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
ইসহাক সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, চলে যাচ্ছেন নাকি?
জ্বি, চলে যাচ্ছি। আপনার অত্যন্ত অপমানসূচক কথা শুনতে ইচ্ছা করছে না।
কি করবেন বলুন, আমি তো আর বিড়াল না। বিড়াল হলে হয়তো আমার কথাগুলি খুব অপমানসূচক মনে হত না।
আফসার সাহেব নিজের ঘরে ঢুকলেন। অসহ্য রাগে শরীর কাঁপছে। রাগ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। রীতিমতো বমি এসে যাচ্ছে। এই মানুষটি তাঁকে এ-জাতীয় অপমান আগেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। এত অপমানের ভেতর চাকরি করার কোনো মানে হয় না। কোনো মানে হয় না। তাঁর কিছু সঞ্চয় আছে। মিরপুরে জায়গা কিনে রেখেছেন। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড থেকে লাখ তিনেক টাকা পাওয়ার কথা। বয়স এমন কিছু হয় নি। চেষ্টাচরিত্র করলে আরেকটা চাকরি কি জোগাড় করতে পারবেন না? তিনি কাজ জানেন জাহাজ চলাচল জাতীয় যে-কোনো প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি পাওয়ার কথা।
তিনি পি. এ.-কে ডেকে রেজিগনেশন লেটার ডিকটেট করলেন। ড্রাফট দেখে দুটা বানান ঠিক করলেন। চিঠি টাইপ করে আনতে পাঠালেন। পি. এ.ব সাধারণত কোনো কাজই দ্রুত করে না। এই কাজটা সে অত্যন্ত দ্রুত করল। তিনি চিঠিতে সই করলেন। সই করার পর তাঁর গায়ের জ্বালা খানিকটা কমল। মন শান্ত হল। নাজিমকে চা বানাতে বললেন। নাজিম চা বানিয়ে আনল।
জ্বি স্যার।
চাকরি ছেড়ে দিয়েছি নাজিম।
স্যার, শুনেছি।
কার কাছে শুনলে?
পি. এ. স্যার চিঠি টাইপ করছিলেন। সবাইকে বলেছেন।
ও, সবাই তাহলে জানে। ভালো, জানলেই ভালো।
আফসার সাহেব বিস্মিত হলেন। সবাই জানে, অথচ কেউ এসে তাঁকে বলল না। রেজিগলেশ্বন লেটার না-দেবার জন্যে। এরা কেউ কি তাঁকে পছন্দ করে না? মানুষ হিসেবে তিনি কি এই সামান্য সহানুভূতিটুকুও পেতে পারেন না? দীর্ঘ পনের বছর তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। কাজে ফাঁকি দেন নি। দশটায় অফিসে আসার কথা, দশটায় এসেছেন। পাঁচটা পর্যন্ত অফিস। কোনো দিন পাঁচটা বাজার দশ মিনিট আগে অফিস ছেড়ে যান নি।
নাজিম।
জ্বি স্যার।
চা ভালো হয়েছে, তুমি এখন যাও।
আফসার সাহেব রেজিগনেশন লেটার পি. এ.-র হাতে জমা দিয়ে অফিস ছেড়ে বের হলেন। তখনো দুপুরে-ল্যাঞ্চের সময় হয় নি। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা ছিল শেষ মুহূর্তে হয়তো সবাই এসে ভিড় করবে। তা-ও কেউ করল না।
তিনি দুপুরে কিছু খেলেন না। বাসায়ও ফিরে গেলেন না। দীর্ঘ সময় রাস্তায়রাস্তায় হাঁটলেন। একসময় ক্লান্ত হয়ে পার্কে ঢুকলেন বিশ্রামের জন্যে। দীর্ঘ আট বছর পর পার্কে এলেন। ঢাকা শহরের পার্কগুলি যে এখনো এত সুন্দর আছে তা তিনি ভাবেন নি। পর্কে বসে থাকতে তাঁর ভালোই লাগল। কিছুক্ষণ আগে ভালো একটা চাকরি ছেড়ে এসেছেন-এই নিয়ে তাঁর মনে কোনো অনুশোচনা বোধ হল না। বরং একধরনের শান্তি অনুভব করলেন। পার্কে বসেই ঠিক করলেন, আজ অন্য দিনের মতো সাড়ে পাঁচটায় বাসায় উপস্থিত হবেন না। নিয়মের ব্যতিক্রম করবেন। একটা ছবি দেখলে কেমন হয়? ছাত্রজীবনে প্রচুর সিনেমা দেখতেন। গত দশ বছরে একটাও দেখেন নি। সিনেমা হলে ঢুকে ছবি দেখতে কেমন লাগে কে জানে!
তিনি বাড়ি ফিরলেন রাত এগারটায়। শীতের দিনে রাত এগারটা মানে অনেক রাত। মীরা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় এতটুকু হয়ে গেছেন। চারদিকে খোঁজখবর করছেন। কেউ কিছু বলতে পারছে না। মীরা ভেবে রেখেছেন, সাড়ে এগারটা পর্যন্ত দেখবেন। তারপর হাসপাতালে-হাসপাতালে খোঁজ নেয়া শুরু করবেন।
আফসার সাহেবকে দেখে আনন্দে তাঁর চোখে প্রায় পানি এসে গেল। সুমী রুমী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল বাবাকে! সুমী কাঁদো-কাদো গলায় বলল, কোথায় ছিলে বাবা?