মীরা বললেন, হ্যাঁ। তাঁর পোশাক-আশাক দেখে বিভ্রান্ত হয়ে না। উনি বিখ্যাত ব্যক্তি। নাম বললেই চিনবে–উনি মিসির আলি।
মিসির আলি আবার কে?
মানসিক সমস্যার বিশ্লেষণের ব্যাপারে তাঁর মতো মানুষ এখনো জন্মায় নি। অতি বিখ্যাত ব্যক্তি।
অতি বিখ্যাত ব্যক্তির হল তো দেখছি ফকিরের মতো! ঘরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে—খেতে পান না।
উনি কখনো কারও কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেন না।
চলে কী করে? আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যারাসাইকোলজি পড়াতেন। এখন চাকরি চলে গেছে। শুনেছি টিউশনি করেন।
আফসার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি কিছু মনে করো না। যত বিখ্যাত ব্যক্তিই হোন, আমার কিন্তু তাঁর উপর বিন্দুমাত্র ভক্তি-শ্রদ্ধা হচ্ছে না।
ভক্তি-শ্রদ্ধার তো কোনো ব্যাপার নেই। তুমি তোমার সমস্যার কথা বলবে– ফুরিয়ে গেল।
আমি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনো কথাই বলব না। উনি চা আনতে গেছেন। চা এলে চা খাব। চলে যাব।
আচ্ছা, এখন বস।
কোথায় বসব? বসার জায়গা কোথায়?
ঘরে বসার জায়গা আসলেই নেই। দুটি চেয়ারের একটার ওপর কেরোসিন কুকার। অন্যটির ওপর গাদাখানিক বই। বিছানায় বসা যায়। তবে সেই বিছানায় চাদরের ওপর কি কারণে জানি খবরের কাগজ বিছানো। বসতে হলে খবরের কাগজের ওপর বসতে হয়।
আফসার সাহেব বিরক্ত মুখে খবরের কাগজের ওপর বসলেন। মীরা বসলেন স্বামীর পাশে। মিসির আলির নামের সঙ্গে মীরার পরিচয় আছে। মুখোমুখি এই প্রথম দেখলেন। মীরার ভাই মহসিন ঠিকানা দিয়েছে। এবং বলেছে-এই লোকের চেহারায় বিভ্ৰান্ত না-হতে। মীরা নিজেও এখন খানিকটা বিভ্ৰান্ত বোধ করছেন। প্রফেশনাল কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়াই ভালো ছিল। অ্যামেচারীদের ওপর খুব ভরসা। করা যায় না।
মিসির আলি চায়ের কেতলি এবং তিনটা কাপ হাতে ঢুকলেন। কাপে চা ঢালতেঢালতে বললেন, আফসার সাহেব, আপনি কেমন আছেন?
ভালো। আমার নাম জানলেন। কী করে?
আপনার শ্যালক মহসিন সাহেব, উনিই আপনার নাম বলেছেন। আপনার সমস্যা কি, তার আভাসও দিয়েছেন। এখন আপনি বলুন, সমস্যাটা আপনার মুখ থেকে শুনি।
ও যা বলেছে তাই। নতুন করে আমার কিছু বলার নেই।
আপনি কি কিছু বলতে চাচ্ছেন না?
জ্বি-না।
কেন বলুন তো?
আফসার সাহেব উত্তর না।
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, যে-কোনো কারণেই হোক, আপনি আমাকে পছন্দ করছেন না। সাইকিয়াটিস্ট হিসেবে আমি সম্ভবত আপনাকে ইমপ্রেস করতে পারি নি! এটা নতুন কিছু না। সবার ক্ষেত্রে ঘটে। তখন আমি কী করি জানেন? এমন কিছু করি, যাতে আমার ওপর বিশ্বাস ফিরে আসে। কারণ পুরোপুরি বিশ্বাস না-আসা পর্যন্ত আমি কোনো সাহায্য করতে পারি না। যেই মুহূর্তে আমার ওপর আপনার পরিপূর্ণ আস্থা আসবে, সেই মুহূর্ত থেকে আপনি আমার কথা মন দিয়ে শুনবেন। আমার যুক্তি গ্রহণ করবেন।
আফসার সাহেব বললেন, তাহলে বিশ্বাস অর্জনের জন্য কিছু করুন।
পারছি না। সবসময় পারি না।
আফসার সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে—রাখতে বললেন, মীরা, চল যাই।
মীরা দুঃখিত গলায় বললেন, তুমি ওঁকে কিছুই বলবে না?
না।
সমস্যাটা নিজের মুখে বলতে অসুবিধা কী?
আফসার সাহেব কঠিন দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, চল যাই। আমার শরীর ভালো লাগছে না। বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকব। তা ছাড়া আমার কোনো সমস্যাও নেই।
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। সহজ গলায় বললেন, চলুন, আপনাদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
তার প্রয়োজন হবে না।
অনেক অপ্রয়োজনীয় কাজ আমি করি আপনাদের জন্যে চা আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবু এনেছি। চা অনেক দূর থেকে আনতে হয়েছে। চা-টা যেন গরম থাকে এ—জন্যে ছুটতে-ছুটিতে এসেছি। চা গরম ছিল না?
আফসার সাহেব একটু বিব্রত বোধ করলেন। মীরা আবার বললেন, বস না। কিছু বলতে না-চাইলে বলবে না। দু মিনিটের জন্যে বস।
আফসার সাহেব বসলেন।
মিসির আলি বললেন, আমার ধারণা, অফিসে চাকরি সম্পর্কিত বড় রকমের সমস্যায় আপনি আছেন। সম্ভবত আপনার চাকরি চলে গেছে। এটা কি ঠিক?
মীরা ভয়ংকরীভাবে চমকে উঠলেন।
আফসার সাহেব চমকালেন না। স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ মিসির আলির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। তবে চাকরি এখনো যায় নি। হয়তো শিগগিরই চলে যাবে। অফিসের মালিকপক্ষের সঙ্গে অনেক দিন থেকেই বনিবন্যা হচ্ছিল না। গত দু মাসে তা চরম আকার নিয়েছে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, হয় ওরা আমাকে ছাড়িয়ে দেবে, নয়তো আমিই রিজাইন করব।
মীরা ক্ষীণ গলায় বললেন, এইসব কিছুই তো তুমি আমাকে বল নি।
আফসার সাহেব বললেন, তোমাকে বলার সময় হয় নি বলেই বলি নি। সময় হলে নিশ্চয়ই বলতাম।
এত বড় একটা ব্যাপার তুমি গোপন করে রাখবে?
হ্যাঁ, রাখব।
আফসার সাহেব পকেট থেকে সিগারেট বের করতে—করতে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার এই ব্যাপার আপনি কী করে অনুমান করলেন?
খুব সহজেই অনুমান করেছি। কোনো মানসিক সমস্যা যখন হয় তখন তার পিছনে কিছু-না-কিছু কারণ থাকে। পারিবারিক অশান্তি, চাকরির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি। একটা ছোটো বাচ্চা যখন পরিবারের কারো সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায় না, যখন সে দেখে বাবা-মা সারাক্ষণ ঝগড়া করছেন-তখন সে কথা বলা শুরু করে টবের ফুলগাছের সঙ্গে। এমনভাবে কথা বলে, যেন ফুলগাছটা তার কথা শুনছে, কথার জবাব দিচ্ছে। আসলে এ-রকম কিছু ঘটছে না।