মা : চা খাচ্ছেন।
অসুস্থ বিড়াল : আমার একটু চা খেতে ইচ্ছা করছে মা।
মা : ইচ্ছা করলেই তো খাওয়া যায় না সোনা।
আফসার সাহেব উঠে পড়লেন। ফ্ৰীজ খুলে দুধ বের করলেন। বাটিতে দুধ ঢাললেন। কয়েক টুকরা পাউরুটি নিলেন। খানিকটা জেলিও পিরচের এক কোণায় দিলেন। খাবারগুলি পিলারের কাছে রাখলেন। চায়ের কাপে সামান্য চা ছিল। একটা পিরিচে তা-ও ঢেলে এগিয়ে দিলেন।
ছোট বিড়াল; মা, উনি এ-সব করছেন কেন?
মা : বুঝতে পারছি না।
ছোট বিড়াল : উনি কি আমাদের খেতে দিচ্ছেন?
মা : তা-ই তো মনে হচ্ছে!
ছোট বিড়াল : আমরা কি খাব?
মা : একটু অপেক্ষা করে দেখি।
ছোট বিড়াল : আমার ভয়ভয় লাগছে মা। আমার মনে হচ্ছে খেতে যাব, আর ওমনি উনি আমাদের ধরে বস্তায় ভরবেন।
মা : অন্যের সম্পর্কে এত ছোট ধারণা করতে নেই মা! এতে মন ছোট হয়। উনি ভালবেসে খেতে দিয়েছেন। এস, আমরা খাই।
তারা তিন জনই এগিয়ে গেল। ছোট বিড়াল দুটি একসঙ্গে দুধের বাটিতে জিত ভেজাতে লাগল। মা-বিড়াল বিরক্ত হয়ে বলল, তোমরা দেখি ভদ্রতা কিছুই শিখলে না! উনাকে ধন্যবাদ দেবে না? ধন্যবাদ দাও! ছোট বিড়াল দুটি একসঙ্গে বলল, ধন্যবাদ।
খাওয়া শেষ করে আর একবার ধন্যবাদ দেবে।
আচ্ছা।
ছোটো বিড়ালটা বলল, পিরচের গায়ে লাল রঙের এই জিনিসটা কী মা?
এর নাম জেলি, রুটি দিয়ে খায়। তোমাদের জেলি খাওয়া ঠিক হবে না।
কেন মা?
এতে দাঁত খারাপ হয়।
এই পর্যায়ে মীরা শোবার ঘর থেকে বের হলেন। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আফসার সাহেব থমথমে গলায় বললেন, তুমি কি বিড়ালগুলিকে বস্তায় ভরে ফেলে দিতে বলেছিলে?
মীরা বললেন, তোমাকে কে বলল?
ফেলে দিতে বলেছিলে কি বল নি?
হ্যাঁ, বলেছিলাম।
খুব অন্যায় করেছ।
অন্যায় করব কেন? এর আগেও তো একবার বস্তায় ভরে বিড়াল ফেলা হয়েছে। সেবার তো তুমিই ফেলতে বলেছিলে। বল নি?
আর ফেলবে না।
এদেরকে কি তুমিই খাবার দিয়েছ?
হ্যাঁ।
এখনো কি তুমি এদের কথা বুঝতে পারছ?
পারছি।
মীরা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর মনে হল ব্যাপারটাকে আর অবহেলা করা ঠিক হবে না। কোনো- একজন ডাক্তারের কাছে তাঁকে নিতে হবে। কোনো বড় মনোবিজ্ঞানী, যিনি ব্যাপারটা বুঝবেন।
নাশতার টেবিলে মীরা বললেন, আজ সন্ধ্যায় তোমাকে যদি কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাই, তুমি যাবে?
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে?
হ্যাঁ।
সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কোন যাব? তোমার কি ধারণা, আমি পাগল?
না, তুমি পাগল না। আবার ঠিক সুস্থও না। কোনো সুস্থ মানুষ কখনো বলবে না, সে বিড়ালের কথা বুঝতে পারছে।
আফসার সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না।
মীরা বললেন, তুমি অফিসে চলে যাও। ঘরে বসে-বসে বিড়ালের কথা শুনলে হবে না। এইসব নিয়ে একেবারেই চিন্তা করবে না। সন্ধ্যাবেলা আমরা একজন বড় ডাক্তারের কাছে যাব।
ঠিক আছে, যাব। কিন্তু বিড়ালগুলিকে তুমি তাড়াবে না। দুপুরে আলাদা করে খেতে দেবে। রাতেও খেতে দেবে। মনে থাকে যেন।
তোমার কি মনে হয় না, তুমি বাড়াবাড়ি করছ?
আফসার সাহেব শীতল গলায় বললেন, না, আমি বাড়াবাড়ি করছি না। বলেই মনে হল হয়তো তিনি ঠিক বলছেন না। কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এখন তাঁর আচরণ নিশ্চয়ই সহজ-স্বাভাবিক মানুষের আচরণ নয়। অস্বাভাবিক একজন মানুষের আচরণ। তাঁকে যদি কেউ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না। তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, মীরা, এ কী সমস্যায় পড়া গেল বল তো!
মীরা বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আফসার সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর কেন জানি মনে হচ্ছে, কিছুই ঠিক হবে না। যতই দিন যাবে ততই সব এলোমেলো হয়ে যাবে।
পাগলের ডাক্তারদের চেহারা
পাগলের ডাক্তারদের চেহারায় না-হোক, চোখে খানিকটা পাগল-পাগল ভাব থাকে। তারা সহজভাবে আলাপ-আলোচনা করতে-করতে দুম করে কঠিন কোনো কথা বলে সরু চোখে রুগীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কথাবার্তা বলতে হয় বিছানায় শুয়ে। একটা ছবি চোখের সামনে ধরেজিজ্ঞেস করে, ছবি দেখে আপনার মনে যা আসছে বলুন তো! কী দেখছেন ছবিতো? পাগলের ডাক্তার বা সাইকিয়াটিস্ট সম্পর্কে আফসার সাহেবের এই ছিল ধারণা। তিনি এমন একজন লোকের সঙ্গে দেখা করবেন, এ-জাতীয় মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বেরুলেন। যাঁর সঙ্গে দেখা হল তাকে দেখে মোটামুটি হতাশই হলেন। লুঙ্গি-পরা আধাবুড়ো একজন লোক, যে দরজা খুলেছে খালি গায়ে এবং তাঁদের দেখেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে শার্ট খুঁজতে শুরু করেছে। আলনায় বেশ কয়েকটা শার্ট এক জায়গায় রাখা। একটা নিতে গিয়ে ভদ্ৰলোক সব কটা ফেলে দিলেন। যে—শার্ট গায়ে দিলেন তার সবগুলি বোতাম সাদা রঙের, কিন্তু মাঝখানের একটা বোতাম কালো।
ভদ্রলোক বিব্রত গলায় বললেন, আসুন, আসুন। আপনাদের সাতটার সময় আসার কথা ছিল না?
মীরা বললেন, একটু আগে এসে পড়েছি। বাসা খুঁজে পাব কি না বুঝতে পারছিলাম না, এই জন্যে সকল—সকাল রওনা হয়েছিলাম। আগে এসে আপনাকে অসুবিধায় ফেলি নি তো?
জ্বি-না, কোনো অসুবিধা নেই। বসুন, আমি চায়ের ব্যবস্থা করি।
ভদ্রলোক তাঁদের কিছু বলার সুযোগ না-দিয়ে ছোটো একটা কেতলি হাতে বের হয়ে গেলেন। পায়ে স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল, পরনে লুঙ্গি। সেই লুঙ্গিও যে খুব ভদ্রভাবে পরা, তা নয়। মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় কোমর থেকে খুলে আসবে।
আফসার সাহেব বললেন, এই তোমার সাইকিয়াটিস্ট?