আফসার সাহেব বললেন, আমি যে বিড়ালের কথা বুঝতে পারি তা কি তুমি বিশ্বাস কর?
মীরা বললেন, হ্যাঁ, করি।
না। তুমি বিশ্বাস কর না। আমাকে সত্ত্বনা দেবার জন্য বলছি।
তুমি ঘুমুবার চেষ্টা কর।
চেষ্টা করছি।–লাভ হচ্ছে না। আমার এ কী সর্বনাশ হল বল তো?
কোনো সর্বনাশ হয় নি। দেখবে কাল ভোরেই সব ঠিক হয়ে গেছে।
কীভাবে ঠিক হবে?
আমি ব্যবস্থা করব।
কী ব্যবস্থা করবো?
ভোর হোক, তখন দেখবে।
শেষবরাতের ঠাণ্ডায়—ঠাণ্ডায় আফসার সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল সকাল দশটায়। বাসা খালি। বাচ্চারা স্কুলে চলে গেছে। মীরা নাশতা বানিয়ে অপেক্ষা করছেন। আফসার সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে নাশতার টেবিলে বসলেন। আশেপাশে বিড়ালগুলিকে দেখতে পেলেন না। খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। মীরা বললেন, আজ অফিসে গিয়ে লাভ নেই। রাতে ভালো ঘুম হয় নি। বাসায় থাক, রেষ্ট নাও!
আরে না। পরপর দু দিন কামাই দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ভালো কথা—বিড়ালটা কোথায়?
জানি না। আছে নিশ্চয়ই কোথাও। বাদ দাও তো।
আফসার সাহেব অফিসে চলে গেলেন। অফিসে নানান কাজে সময় কেটে গেল।
একটা মীটিং ছিল, মীটিং শেষ করে বাসায় ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
বাসায় ফিরে স্বস্তি বোধ করলেন। বিড়াল নেই। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, তবে বুঝলেন—কুদ্দুস এদের বাসা থেকে তাড়িয়েছে। ভালোই করেছে। অনেকদিন পর আফসার সাহেব সুমী রুমীকে সঙ্গে নিয়ে টিভি দেখলেন। কি একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হচ্ছে। ভয়ংকর রোগা একটা লোক নানা ধরনের আবোল-তাবোল কথা বলে হাসাবার চেষ্টা করছে। আফসার সাহেবের ক্ষমতা থাকলে চড় দিয়ে বদমাশটার সব কটা দাঁত ফেলে দিতেন। ক্ষমতা নেই বলে কিছু করতে পারলেন না। রুমী বলল, লোকটা কি রকম মজা করতে পারে দেখলে বাবা? এমন হাসাতে পারে!
তিনি হু-জাতীয় শব্দ করলেন এবং ভাব করলেন যেন মজা পাচ্ছেন। রাতে দুই মেয়ে যখন স্কুলে কি-সব ঘটনা ঘটেছে বলতে শুরু করল, সে-সবও তিনি মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। স্নাত দশটায় মহসিন টেলিফোন করল :
দুলাভাই, ভালো?
হ্যাঁ, ভালো।
বিড়ালের কথা নিশ্চয়ই আর শোনেন নি?
না।
ভেরি গুড। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে ঘুমের ট্যাবলেট দুটা মনে করে খাবেন।
আচ্ছা।
এই সঙ্গে আপনাকে একটা ছোট্ট অ্যাডভাইস দিচ্ছি। সবসময় এমন কঠিন ভাব করে থাকবেন না। রিল্যাক্স করুন। হাসুন, গল্প করুন। সবাইকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যান।
কোথায় যাব?
কক্সবাজার চলে যান। আসলে আপনার যা হয়েছে তা হল-নাৰ্ভ উত্তেজিত হয়েছে। নাৰ্ভ একসাইটেড হলে এ-সব হতে পারে। রাখি দুলাভাই?
আচ্ছা।
রাত এগারটার দিকে হাত-মুখ ধুয়ে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে আফসার সাহেব ঘুমুতে গেলেন। ঘুমের ট্যাবলেট খাবার ইচ্ছে ছিল না—এমনিতেই ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তবু দুটা ট্যাবলেট খেলেন! ভালো ঘুম হল। একটানা ঘুম ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। তিনি শোবার ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে বসলেন। রাতে ভালো ঘুম হওয়ায় শরীরটা ঝরঝরে লাগছে। বারান্দায় বসে সকাল হওয়া দেখতে তাঁর সবসময়ই ভালো লাগে। এক কাপচা পেলে হত। চা বানানোর কেউ নেই। সবাই ঘুমুচ্ছে। তিনি নিজেই রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। চা বানানো এমন কোনো কঠিন কর্ম না। পানি গরম করতে পারলেই হল।
চায়ের কাপ হাতে আফসার সাহেব চেয়ারে এসে বসলেন। তখনই মা– বিড়ালটাকে দেখতে পেলেন। পিলারের আড়ালে চুপচাপ বসে আছে। বাচ্চা দুটিও আছে। হাঁটা, তারা কথা বলছে। আফসার সাহেব তাদের প্রতিটি কথা বুঝতে পারছেন।
ছোট বিড়াল : মা দেখ, ভদ্রলোক চা খাচ্ছেন।
মা : বললাম না চুপ থাকতে, কথা বলছিস কেন?
ছোট বিড়াল : মা, উনাকে জিজ্ঞেস কর তো-কেন আমাদের বস্তায় ভরে ফেলে দিয়ে এল?
মা : আহ্! কী যে বোকার মতো কথা বলিসা মানুষ কি আমাদের কথা বোঝে? বুঝলে তো সব সমস্যার সমাধানই হত। মানুষ যদি একবার পশুদের কথা বুঝত তাহলে পশুদের আর কোনো দুঃখ থাকত না।
ছোট বিড়াল : যদি আমাদের কথা বুঝতে পারত। তাহলে আমি উনাকে কী বলতাম, জান?
মা :কী বলতে?
ছোট বিড়াল : বলতাম–কেন আপনারা আমাদের এমন কষ্ট দিলেন? সারা রাত হোটে-হেঁটে এসেছি। আমরা তো ছোট, আমাদের বুঝি কষ্ট হয় না?
ছোট বিড়াল দুটির একটি শুধু কথা বলছে। অন্যটি শুয়ে আছে। মা-বিড়ালটি একটু পরপর জিভ দিয়ে শুয়ে থাকা বাচ্চাটাকে চেটে দিচ্ছে। এই বিড়ালটা খুবই অসুস্থ। দীর্ঘ পথ হেঁটে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মা-বিড়াল তার কানে—কানে বলল–
মা বিড়াল : খুব খারাপ লাগছে মা?
অসুস্থ বিড়াল হ্যাঁ।
মা : খিদে লেগেছে?
অসুস্থ বিড়াল : হ্যাঁ।
মা : আমার লক্ষ্মী সোনা। চুপ করে শুয়ে থাক। দেখি কিছু পাওয়া যায় কি না।
অসুস্থ বিড়াল : মা, আমরা কি লুকিয়ে থাকব?
মা : লুকিয়ে থাকাই ভালো। দেখতে পেলে ওরা হয়তো আবার আমাদের বস্তায় ভরে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসবে।
অসুস্থ বিড়াল : মানুষরা এমন কেন?
মা : পৃথিবীটা তো মা মানুষরাই দখল করে নিয়েছে। পৃথিবী এখন চলছে। ওদের ইচ্ছামতো।
অসুস্থ বিড়াল : পৃথিবী ওরা দখল করে নিয়েছে কেন মা?
মা : ওদের বুদ্ধি বেশি।
অসুস্থ বিড়াল : আমাদেরও তো মা বৃদ্ধি বেশি। তোমার মতো বৃদ্ধিতো কারোরই নেই।
মা : আমাদের বুদ্ধি কোনো কাজে লাগে না রে মা। আর কথা বলিস না। তোর শরীর দুর্বল।
অসুস্থ বিড়াল :মা, ঐ ভদ্রলোক কী খাচ্ছেন?