মীরা তাঁকে বিছানায় গুইয়ে দিলেন। জানালার পর্দা টেনে ঘর খানিকটা অন্ধকার করে দিলেন।
তুমি চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম নাও। আমি মহসিনকে খবর দিচ্ছি। ও বিকেলে এসে তোমার প্ৰেশার মাপবে।
আফসার সাহেব কিছু বললেন না। মহসিন এসে তাঁর প্ৰেশার মাপবে এই খবরও তাঁর ভালো লাগল না। মহসিন মীরার সবচেয়ে ছোট ভাই। কিছুদিন হল ডাক্তারি পাস করে বের হয়েছে। এমনিতে ছেলে খুব ভালো, তবে ঠাট্টা-তামাশা বড় বেশি করে। সহ্য করা যায় না।
মীরা।
কি?
মহসিনকে খবর দেবার দরকার নেই।
আচ্ছা যাও, খবর দেব না।
তুমি একটু বস তো আমার পাশে।
মীরা বসলেন। কপালে হাত দিয়ে স্বামীর গায়ের উত্তাপ দেখলেন। গা ঠাণ্ডা, জ্বর নেই। কিন্তু চোখ-মুখ যেন কেমন দেখাচ্ছে। যে-কোনো কারণেই হোক মানুষটা খুব ভয় পেয়েছে। গলার স্বরও জড়ানো।
মীরা।
কী?
আফসার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, তুমি কি বিড়ালের কথা বুঝতে পার?
মীরা হতভম্ব হয়ে বললেন, বিড়ালের কথা বুঝতে পারি মানে! এ-সব কী বলছ?
আফসার সাহেব অত্যন্ত বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমার ধারণা বিড়াল মাঝেমাঝে মানুষের মতো কথা বলে। মন দিয়ে শুনলে ওদের সব কথা বোঝা যায়।
মীরা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি ওদের কথা বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ।
বুঝতে পারলে ভালো। এখন ঘুমুতে চেষ্টা কর।
আফসার সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। রুমী সুমী স্কুলে গেল না। মাঝেমাঝে পা টিপে-টিপে এসে বাবাকে দেখে গেল। সুমী বাবার কানে-কানে বলল, তোমার কী হয়েছে বাবা? তিনি জবাব দিলেন না। তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
মা-বিড়ালটা একবার এসে ঘুরে গেল। সে দুঃখিত গলায় তার বাচ্চাদের বলল, বেচারা আজ অফিসে গেল না কেন বুঝতে পারছি না। অসুখবিসুখ করল কি না কে জানে? চারদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা হচ্ছে।
একটা বাচ্চা বলল, ইনফ্লুয়েঞ্জা কী মা?
একটা রোগের নাম। এইসব তুমি বুঝবে না। সবসময় প্রশ্ন করে বিরক্ত করবে না।
প্রশ্ন না করলে জানব কী করে?
মা-বিড়াল বলল, এখন এ-ঘর থেকে চলে যাও। বেচারা ঘুমানর চেষ্টা করছে। তাকে ঘুমুতে দাও।
ইনফ্লুয়েঞ্জা কী, তা তো তুমি বললে না!
বললাম তো ইনফ্লুয়েঞ্জা একটা অসুখের নাম। তখন জ্বর হয়, মাথায় পানি ঢালতে হয়।
আমাদের কি ইনফুয়েঞ্জা হয়?
না, আমাদের হয় না।
আমাদের কী কী অসুখ হয় মা?
আহ্, চুপ কর তো! বেচারাকে কি তোমরা ঘুমুতে দেবে না?
আমাদের কী কী অসুখ হয় সেটা যদি তুমি আমাদের না-বল তাহলে আমরা শিখব কী করে?
বারান্দায় চল। কারান্দায় বলব।
বিড়াল তার দু বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। বাচ্চা দুটির যাবার তেমন আগ্ৰহ নেই। বারবার ফিরে তাকাচ্ছে।
আফসার সাহেব সারা দিন বিছানায় শুয়ে রইলেন। তাঁর বুক ধকধক করছে, মাথা ঘুরছে। এ কী সমস্যা! এ কী সমস্যা!
সন্ধ্যাবেলা তাঁর ছোট শ্যালক মহসিন এসে উপস্থিত। সঙ্গে প্ৰেশার মাপার যন্ত্র। মীরা বলেছিল তাকে খবর দেবে না। কিন্তু খবর দিয়েছে। মীরা কথা রাখেনি। আফসার সাহেব মহসিনকে সহ্যই করতে পারেন না, দেখামাত্র তাঁর মাথায় রক্ত উঠে যায়। আজও উঠে গেল। মহসিন দাঁত বের করে বলল, কেমন আছেন দুলাভাই?
তিনি শুকনো গলায় বললেন, ভালো।
শুনলাম আজ অফিসে যান নি।
শরীরটা ভালো লাগছে না।
শুয়ে-শুয়ে কী করছেন?
কিছু করছি না।
বুবু বলছিলেন–আপনি নাকি এখন অ্যানিম্যাল ল্যাংগোয়েজে এক্সপার্ট হয়ে গেছেন—হা-হা-হা।
আফসার সাহেবের ইচ্ছে করল। ফাজিলটার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন।
বিড়ালের সব কথা নাকি বুঝে ফেলছেন?
আফসার সাহেব চুপ করে রইলেন। মহসিন বলল, বিড়াল কোন ভাষায় কথা বলে দুলাভাই? সাধুনা চলিত?
আমার শরীরটা ভুলো লাগছে না।–তুমি অন্য ঘরে যাও।
রাগ করছেন নাকি?
না, রাগ করছি না। তুমি আমাকে একটু একা থাকতে দাও!
আগে প্ৰেশারটা মাপি, তারপর যত ইচ্ছা একা থাকবেন।
প্ৰেশার মাপা হল। দেখা গেল প্ৰেশার স্বাভাবিক। মহসিন বলল, আপনার সমস্যা কি জানেন দুলড়াই? আপনার সমস্যা হচ্ছে-গাষ্ঠীর্য একটু সহজ হোন। স্বাভাবিকভাবে হাসি-তামাশায় জীবন পার করার চেষ্টা করুন। দেখবেন, বিড়ালের কথা আর শুনতে পাচ্ছেন না।
তুমি যাও তো এ-ঘর থেকে।
যাচ্ছি। কয়েকটা ঘুমেরট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। রাতে দুটা খেয়ে ঘুমুবেন। আপনার ঘুম দরকার।
আফসার সাহেব মীরার ওপর খুবই রাগ করলেন। মীরা কাজটি ঠিক করে নি। কেন সে এই ব্যাপারটা জানাচ্ছে? বিড়ালের কথা বুঝতে পারার পুরো ব্যাপারটা যে হাস্যকর তা কি তিনি বোঝেন না? খুব ভালো বোঝেন। তিনি জানেন, তাঁর কোনো সমস্যা হয়েছে… হয়তো মাথা গরম হয়ে আছে কিংবা কানো কোনো সমস্যা হয়েছে। এটা কি লোকজনকে বলে বেড়ানোর মতো ঘটনা? সবকিছু সবাইকে বলতে নেই, এই সাধারণ বুদ্ধি কি মীরার নেই?
দেখা গেল, সন্ধ্যা নাগাদ লোকজনে বাড়ি ভরে গেল। ঢাকার আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই এসে গেছেন। সবার মুখে রহস্যময় হাসি। রাগে-দুঃখে আফসার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।
এমন অবস্থা হবে জানলে তিনি কিছুতেই মীরাকে ব্যাপারটা বলতেন না।
আফসার সাহেব সারারাত জেগে কাটালেন। এক ফোঁটা ঘুম হল না। তন্দ্ৰামতো আসে আর মনে হয় কী ভয়ংকর কাও ঘটে গেছে—, তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন! তখনি ঘুম ভেঙে যায়। তিনি ধড়মড় করে উঠে বসেন। তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে মীরাও রাত জেগেই কটালেন। মীরা একসময় বললেন, এত অস্থির হচ্ছ কেন? যদি বিড়ালের কথা বুঝতে পার-পারলে। এতে অসুবিধা তো কিছু হচ্ছে না।