মেঝে পরিষ্কার করার জন্যে কাজের ছেলে কুদ্দুস এসেছিল। আফসার সাহেব তার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই সে ভয় পেয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। তারও কি হাসির রোগ আছে? রান্নাঘর থেকে হাসির মতো আওয়াজ আসছে। হ্যাঁ, কুদ্দুস ব্যাটাও হাসছে।
বিড়াল পরিবার মহানন্দে খেয়ে যাচ্ছে। আফসার সাহেবের রাগ ক্রমেই বাড়ছে। তিনি ঠিক করে ফেললেন-ডান পায়ে বিড়ালটার গায়ে একটা দুৰ্দান্ত কিক বসাকেন, যাতে সে ভবিষ্যতে কখনো এইভাবে তাঁকে অপদস্থ না-করে। বসাতে যাবেন, তখন একটা ব্যাপার ঘটল। তিনি পরিষ্কার শুনলেন-মা-বিড়ালটা যে-সব কথা বলছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। ম্যাও ম্যাও করেই নিচু গলায় কথা বলছে, কিন্তু তিনি প্রতিটি শব্দ বুঝতে পারছেন। এ কী অদ্ভুত কাণ্ড!
মা-বিড়ালটা বলছে, খোকাথুকু সাবধান! লোকটা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, মতলব ভালো না। মনে হচ্ছে উঠে দাঁড়াবে।
একটা বাচ্চা বিড়াল বলল, উঠে দাঁড়ালে কী হয় মা?
লাথি মারতে পারে। তোমরা একটু দূরে সরে যাও।
কতটা দূরে যাব?
খুব বেশি দূর যেতে হবে না। লাথি মারলেও সে তোমাদের মারবে না। আমাকে মারবে। মানুষ কখনো বিড়ালের বাচ্চার গায়ে হাত তোলে না।
কেন মা?
মানুষের মনে মায়া বেশি, এই জন্যে। তবু সাবধানের মার নেই। এই লোক খুব রেগে আছে। রেগে গেলে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। কি করতে কি করে বসবে। কী দরকার রিস্ক নিয়ে?
রিস্ক কী মা?
রিস্ক হচ্ছে একটা ইংরেজি শব্দ। এর বাংলাটা ঠিক জানি না।
বিড়ালের বাচ্চা দুটি অনেকটা দূরে চলে গেল। সেখান থেকে তাকিয়ে রইল আফসার সাহেবের দিকে। আফসার সাহেব পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন। ব্যাপারটা কী? বিড়ালের মানুষের মতো কথা বলার কোনোই কারণ নেই। শুধুমাত্র রূপকথার বইতে পশু-পাখি মানুষের মতো কথা বলে। এটা কোনো রূপকথা নয়। তিনি বিংশ শতাব্দীতে বাস করছেন। বাবর রোডের দোতলা বাসার ডাইনিং রুমে বসে আছেন। অফিসের গাড়ি চলে এসেছে, এখন অফিসে যাবেন। এই সময় বিড়ালের ভাষা তিনি বুঝতে পারছেন, তা হতেই পারে না। বিড়াল একটিমাত্র শব্দ জানে-মিয়াঁও। এই শব্দের কোনো মানে নেই। আর থাকলেও মানুষের তা বোঝার কথা না।
আফসার সাহেব সিগারেট ধরালেন।
একটা বিড়ালের বাচ্চা তখন কথা বলে উঠল, মা, লোকটা সিগারেট ধরিয়েছে। এখন বোধহয় আর আমাদের মারবে না।
বিড়ালের মা বলল, আমারও তাই ধারণা। তবে খোকাখুকু, এখন একটু সাবধানে থাক। কারণ লোকটা জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা ছুঁড়ে ফেলবে। গায়ে লাগলে তোমাদের পশমে আগুন ধরে যাবে। মনে নেই একবার জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরায় পা দিয়ে পা পুড়িয়ে ফেললে, মনে আছে?
আছে। আচ্ছা মা, তোমার এত বুদ্ধি কেন?
দূর বেটিা আমার বুদ্ধি নেই।
তোমার অনেক বুদ্ধি। তুমি লাফ দিয়ে ওই লোকটার কোলে বসলে-এই জন্যেই তো সে নাশতার প্লেট মেঝেতে ফেলে দিলা তার নাশতা এখন আমরা খাচ্ছি। আচ্ছা! মা, তুমি রোজ এই রকম কর না কেন?
এ-রকম রোজ করা যায় না। পরপর দুদিন করলেই এরা রাগ করবে। আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। একদিন করেছি। তো, সবাই ভাবছে অ্যাকসিডেন্ট।
অ্যাকসিডেন্ট কী মা?
অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে একটা ইংরেজি শব্দ। এর মানে দুর্ঘটনা।
তুমি ইংরেজিও জান?
অল্প-অল্প জানি, শুনে-শুনে শিখেছি। বাটার মানে মাখন, চীজ হল পনির, নরমাল ওয়াটার মানে পানি, তবে ফ্রীজের পানি না।…
ইস্ মা, তোমার যে কী বুদ্ধি!
আফসার সাহেবের মাথা ঘুরছে। গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এ-সব কী? তাঁর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ-সব তো মাথা-খারাপের লক্ষণ। তিনি দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলেন তাঁর বংশে কোনো পাগল আছে কি না। মনে পড়ল না। তিনি তাকালেন। বিড়ালগুলির দিকে।
ছোট বিড়ালটা বলল, মা-দেখ, লোকটা আমার দিকে তাকাচ্ছে।
বিড়ালের মা বলল, লোকটা-লোকটা বলছি কেন? এইসব অসভ্যতা। আমরা উনার বাড়িতে থাকি। সম্মান করে কথা বলা উচিত।
কী বলব মা?
স্যার বল। স্যার বলাই ভালো। কিংবা ভদ্রলোক বলতে পার।
ভদ্রলোক বলা কি ঠিক মা? উনি একবার আমাদের বস্তায় ভরে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন।
ফেলে তো দেয় নি।
উনার মেয়েগুলির জন্যে ফেলেননি। মেয়েগুলি কাঁদতে লাগল। লোকটা ভালো না মা। খারাপ লোক। সবসময় বকাঝকা করে।
সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে আসে। বকাঝকা করবে না তো কি! এই সব ছোটখাটো দোষ ধরতে হয় না।
একবার তোমার গায়ে লাথি দিয়েছিল মা!
মনের ভুলে দিয়েছে। রোজ তো আর দেয় না।
আফসার সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। কী সর্বনাশ, এ-সব কী হচ্ছে! ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, মীরা-মীরা। প্লীজ, তাড়াতাড়ি আস!
মীরা ছুটে বের হয়ে এলেন। রুমী সুমীও এল। তারা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। কুদ্দুসও রান্নাঘর থেকে মাথা বের করেছে। মীরা বললেন, কী ব্যাপার?
আফসার সাহেব কিছু বলতে পারলেন না। তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন, এই হাস্যকর কথা তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব না। নিশ্চয়ই তাঁর শরীর খারাপ করেছে। মাথায় রক্ত উঠে গেছে কিংবা এই জাতীয় কিছু।
মীরা বললেন, তোমার মুখ এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ করেছে?
হুঁ। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল।
নিশ্চয়ই প্ৰেশার। মহসিনকে খবর দেব? ও এসে তোমার প্ৰেশার মেপে দেবে।
কাউকে খবর দেবার দরকার নেই।
প্ৰেশার মাপলে ক্ষতি তো কিছু নেই। আর শোন, আজ অফিসে যাবারও দরকার নেই। প্রচুর ছুটি তোমার পাঞ্ছনা। অতিরিক্ত কাজের চাপে তোমার এই অবস্থা হয়েছে। সুমী, যা তো, নিচে গিয়ে ড্রাইভারকে বলে আয় আজ তোর বাবা অফিসে যাবে না।