মীরা বললেন, আজ রাতটা তুই থেকে যা মহসিন, নতুন জায়গা, ভয়ভয় লাগছে।
আমি থাকব। দুলাভাইকে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্বও আমার। আজ রাত নিয়ে তুমি চিন্তা করবে না।
মহসিন শোবার ঘরে গিয়ে বসল। আফসার সাহেব চুপচাপ সিগারেট টানছেন। তাঁকে আজ তেমন অস্থির বোধ হচ্ছে না। রুমী সুমী তাঁর পাশেই কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমুচ্ছে।
মহসিন বলল, দুটা ফ্রিজিয়াম খেয়ে আজ সারা রােত আপনি মড়ার মতো ঘুমুবেন, বুঝতে পারছেন?
আফসার সাহেব বললেন, অষুধ খেয়ে কোনো লাভ নেই, ঘুম আসবে না। ঘুমুলেই দুঃস্বপ্ন দেখব-এই টেনশানে আমার ঘুম আসে না।
আজ টেনশন করতে হবে না। আমি সারা রাত আপনার বিছানার পাশে জেগে। বসে থাকব। যখনই আপনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করবেন, আমি আপনাকে ডেকে তুলব।
বুঝবে কী করে আমি স্বপ্ন দেখছি কি না?
স্বপ্ন দেখার সময় মানুষের চোখের পাতা কাঁপতে থাকে। একে বলে rapidleye movement, সংক্ষেপে REM। যখনই দেখব আপনার চোখের পাতা কাঁপছে, আমি আপনাকে ডেকে তুলব। আমার ওপর আপনি বিশ্বাস রাখুন, আমি আপনার খাটের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসব।
মহসিন আসলেই তাই করল।
আফসার সাহেব ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমুতে গেলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, মাথা বুলিশে ছোঁয়ানোমাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন, এবং চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখলেন।–স্বপ্নেও তিনি ঘুমুচ্ছিলেন। ঘুম ভাঙলে তিনি চোখ মেললেন। লক্ষ করলেন, তিনি একটা বেতের ভাঙা সুটকেসের ভেতর শুয়ে আছেন। তাঁর শীত লাগছে। বেশ শীত লাগছে। তিনি মানুষ নন-বিড়াল। সূৰ্যটকেসের ভেতর থেকে উঠে এলেন। খিদে পেয়েছে। খাবারের সন্ধানে যাওয়া উচিত। নানান রকম খাবারের স্ত্ৰাণ পাচ্ছেন। একটা পাউরুটির টুকরার ঘ্রাণ আসছে। পাউরুটিতে মাখন লাগানো মাখনের ঘ্রাণও পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছু পিঁপড়া পাউরুটিতে আছে। তিনি পিঁপড়ার ঘ্রাণও পাচ্ছেন। কোথায় যেন চা ফেলে দিয়েছে। সেই চা শুকিয়ে মেঝেতে সরের মতো পড়েছে। তার গন্ধও নাকে আসছেঃ মেঝের ঐ অংশ চেটে দেখা যেতে পারে। রান্নাঘরের ডাষ্টবিনে কিছু ভাত আছে। তবে ভাত নষ্ট হয়ে গেছে। টক গন্ধ আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, এক জায়গায় বসে তিনি সারা বাড়িতে কোথায় কি খাবার আছে তার গন্ধ পাচ্ছেন। তিনি হাই তুললেন। কোন কোন খাবার খাবেন তা মনে-মনে গুছিয়ে নিলেন। এইবার ইঁদুরের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। একটা মা-ইন্দুর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বের হয়েছে। শুধু গন্ধ দিয়ে তিনি প্রতিটি ইঁদুরকে আলাদা-আলাদা করে চিনতে পারছেন। মাটা ভয়ংকর বদ। একে মারার চেষ্টা করবেন। না, থাক। ছোট-ছোট বাচ্চা আছে। কী দরকার? খিদেও চলে গেছে। ঘুম পাচ্ছে। তিনি আবার বেতের সুটকেসে ঢুকে পড়লেন। স্বপ্নের মধ্যেই আবার ঘুম এসে গেল। ঘুম ভাঙািল রাত তিনটায়। আফসার সাহেব বিছানায় উঠে বসলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, মহসিন চেয়ারের হাতলে মাথা রেখে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। তার নাকও ডাকছে।
আফসার সাহেব সাবধানে বিছানা থেকে নামলেন। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, বারান্দার শেষ প্রান্তে বিড়াল একটা মাত্র বাচ্চা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আফসার সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। আর ঠিক তখন বিড়ালের কথা শুনতে পেলেন।
বাচ্চা : মা, দেখ-দেখ, উনি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
মা : দেখছি।
বাচ্চা : আমরা যে বাসা খুঁজে-খুঁজে এখানে চলে এসেছি তা দেখে উনি কি খুশি হয়েছেন?
মা : না।
বাচ্চা : আমার ভাইটা যে মারা গেছে তা কি উনি বুঝতে পারছেন মা?
মা : মানুষ অসম্ভব বুদ্ধিমান, আমরা দু জন মাত্র এসেছি। তাই দেখে তো বোঝা উচিত।
বাচ্চা : আমাদের মনে যে খুব কষ্ট তা কি উনি বুঝবেন মা?
মা :না। পশুদের কষ্ট মানুষ কখনো বোঝে না।
বাচ্চা : এখন তাঁরা কি আমাদের আবার কস্তায় ভরে ফেলে দেবেন?
মা : দিতে পারে। আবার না-ও দিতে পারে। যখন দেখবে আমরা এত কষ্ট করে। পুরনো বাসায় গিয়েছি, সেখানে তাঁদের না-পেয়ে গন্ধ শুঁকে-শুঁকে এই জায়গায় এসেছি।–তখন অবাক হয়ে আমাদের রাখতেও পারে।
বাচ্চা : খিদে পেয়েছে মা।
মা : ঘুমিয়ে পড়া ঘুমিয়ে পড়লে খিদে লাগবে না।
বাচ্চা : মা।
মা : কি?
বাচ্চা : ভাইটির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে মা। কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
মা : কাঁদতে ইচ্ছা করলে কাঁদ।
আফসার সাহেব শুনলেন বিড়ালের বাচ্চাটা কাঁদছে। এই কান্না অবিকল মানবশিশুর কান্নার মতো। অফিসার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।
খাতায় বিড়ালের ব্যাপারটা লিখেছেন
মিসির আলি বড় একটা খাতায় বিড়ালের ব্যাপারটা লিখেছেন। খাতাটা নিয়ে আফসার সাহেবের বাসায় যাবেন। যাবার আগে লেখাটা আরেক বার দেখে নিচ্ছেন। মিসির আলি লিখছেন :
১. আফসার সাহেব একজন বুদ্ধিমান মানুষ, তবে গম্ভীর প্রকৃতির। ঠাট্টা-তামাশা পছন্দ করেন না। সবকিছু খুব সিরিয়াসভাবে নেন। কাজেই তিনি যখন বলেন বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন, তখন ধরে নেওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি ঠাট্টা-তামাশা করছেন না। একজন বুদ্ধিমান মানুষ কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ বলা শুরু করবেন না যে, তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন। এটা বলায় তাঁর কোনো লাভ হচ্ছে না।– বরং সামাজিকভাবে তিনি হাসির পাত্রে পরিণত হচ্ছেন। আমিও ধরেই নিচ্ছি। তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন। এটা ধরে নিয়ে অন্য যুক্তিগুলি পরীক্ষা করছি।
২ ক্যাসেট প্লেয়ারে বিড়ালের কথা টেপ করা ছিল। তাঁকে শোনানো হল। তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না। এতে দুটি জিনিস প্রমাণিত হচ্ছে—ক তিনি সত্যি কথা বলছেন। মিথ্যা করে বলতে পারতেন যে, কথা বুঝতে পারছেন। মিথ্যা বললেও আমাদের তা ধরার ক্ষমতা ছিল না। খ বিড়াল হয়তো টেলিপ্যাথিক নিয়মে কথা বলে! যদি তার কথা হয় টেলিপ্যাথিক, তবে ক্যাসেট প্লেয়ারে ধরে রাখা বিড়ালের কথা হবে। অর্থহীন। টেলিপ্যাথিক কথা বলার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ বিড়ালের ভোকাল কর্ড মিয়াও ছাড়া অন্য কোনো শব্দ করতে পারে না। একটিমাত্র শব্দে দীর্ঘ বাক্য তৈরি করা বা কথোপকথন চালানো অসম্ভব।