বিছানায় শুয়ে-শুয়ে গান শুনতে ইচ্ছা করছে। মিউজিক সেন্টারটা খুব শখ করে কিনেছিলেন। একটা গানও শোনা হল না। মন-খারাপ লাগছে। মন-খারাপ ভাব কাটানোর জন্যেই আবার র বইটা হাতে নিলেন।
ভয়ংকর বিষধর এবং একই সঙ্গে অপরূপ সুন্দর সাপের নাম ল্যাকেসিস মিউটা। এই ল্যাটিন নামের বঙ্গানুবাদ হল-নিঃশব্দুনিয়তি। বাৰু, কী সুন্দর নাম! মানুষ যেমন এসেছে বাঁদর থেকে, পাখিরা এসেছে সরীসৃপ থেকে। পাখিদের আদি পিতা-মাতা হচ্ছে সরীসৃপ–ভাবতেও যেন কেমন লাগে।
মিসির আলি বইয়ের পাতা উন্টে যাচ্ছেন। তাঁর মন-খারাপ ভাব কেটে যাচ্ছে। গান শুনতে ইচ্ছা করছে। গানের কথা মনে পড়তেই আবার খানিকটা মন-খারাপ হল। পূর্ব দামের একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড কিনে এনেছিলেন। রেকর্ডটা পড়ে আছে। শোনা হয়নি। এই মুহূর্তে তাঁর শুনতে ইচ্ছা করছে-আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে। পূর্ব দাম এই গানটি কেমন গেয়েছেন কে জানে!
ঘরের সব কটা জানালা বন্ধ
আফসার সাহেব গত দু দিন ধরে নিজের ঘর থেকে বের হচ্ছেন না! ঘরের সব কটা জানালা বন্ধ, পর্দা ফেলা দিনের বেলাতেও ঘর অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি খাবার খেতে খাবার টেবিলেও যাচ্ছেন না। খাবার নিয়ে মীরা তাঁর ঘরে যাচ্ছেন। আফসার সাহেব ঠিকমতো খাচ্ছেনও না। অল্প কিছু মুখে দিয়েই বলছেন, খিদে নেই। মীরা বিরাট বিপদে পড়েছেন। কি করবেন বুঝতে পারছেন না বাচ্চাসহ বিড়ালটাকে কস্তায় ভরে আবার ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে। এবার কাছে কোথাও নয়, গাড়ি করে একেবারে জয়দেবপুরে।
মীরা অবশ্যি আফসার সাহেবকে বলেছেন-বিড়ালগুলিকে বাসার বাইরে রাখা হয়েছে। মীরা ভেবেছিলেন এটা শুনে আফসার সাহেব রেগে যেতে পারেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার-রাগেন নি। বরং এই প্রসঙ্গে কোনো কথাও বলেন নি। মনে হচ্ছে বস্তায় ভরে ফেলে দিয়ে আসার ব্যাপারটা তিনিও আন্দাজ করছেন।
আত্মীয়স্বজনরা ক্রমাগত আসছে। কেউ-কেউ দিনের মধ্যে দু বার তিন বার আসছে। মীরার বেশির ভাগ সময় এবং শক্তি ব্যয় হচ্ছে যেন তারা আফসার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে না-পারেন। আত্মীয়স্বজনরা খুব বিরক্ত হচ্ছেন। কেউ-কেউ রােগও করছেন। আফসার সাহেবের এক মামা কঠিন গলায় মীরাকে বললেন, তুমি ওকে লুকিয়ে রাখলে তো লাভ হবে না। ওর চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।
মীরা বললেন, চিকিৎসা হচ্ছে। আপনি তো চিকিৎসক না। আপনি যাবেন—ঐ সব কথা মনে করিয়ে দেবেন। আমি চাই না সে বিড়াল নিয়ে ভাবুক।
আমি বিড়াল নিয়েই যে কথা বলব, তা তোমাকে কে বলল?
আপনি কী নিয়ে কথা বলবেন?
কথা বলার বিষয়ের কি অভাব আছে? আমি পলিটিক্স নিয়ে কথা বলব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলব। এতে ওর উপকার হবে। পুরো ব্যাপারটা ভুলে থাকতে পারবে। ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা তো কোনো সমাধান না।
মীরা তাঁকে ঘরে ঢুকতে দিয়েছেন। তিনি চেয়ারে বসতে-বসতে প্ৰথম যে কথাটা বললেন তা হচ্ছে-আচ্ছা বাবা, বিড়ালের সঙ্গে কী কী কথা তোমার হয়েছে গুছিয়ে বল। কোনো কিছু বাদ দেবে না। দরকার আছে।
শুধু যে আত্মীয়রা আসছে তা নয়-আত্মীয়দের আত্মীয়, তাদের আত্মীয়া মুখচেনা মানুষ,পড়ার মানুষ! পড়ার মানুষদের পরিচিত মানুষ। টেলিফোন সারাক্ষণইবাজছে। মীরা টেলিফোন ধরেন—এমন সব কথাবার্তা তিনি শোনেন যে তাঁর চোখে সত্যি পানি এসে যায়।
পত্রিকার অফিস থেকেও টেলিফোন এল সাপ্তাহিক চক্রবাকের প্রতিবেদক টেলিফোন করেছেন। মীরা টেলিফোন ধরলেন।
আপনি কি আফসার সাহেবের কী?
জ্বি।
আমি সাপ্তাহিক চক্ৰবাক থেকে বলছি।
কি ব্যাপার, বলুন।
আমরা খবর পেয়েছি আপনাদের বাড়িতে একজন বিড়ালে রূপান্তরিত হয়েছেন। তাঁর সারাগায়ে সাদা-সাদা লোম বেরিয়েছে লেজ গজিয়ে গেছে। কথাটা কি সত্যি।
আপনার কি ধারণা। এ-রকম খবর সত্যি হতে পারে?
জগতে অনেক অদ্ভুত-অদ্ভুত ঘটনা তো ঘটে।
ঘটলেও আমাদের এখানে ঘটে নি।
যদি না-ঘটে তাহলে এ-রকম একটা গুজব কী করে রটল?
আমি জানি ৎ কী করে রটল।
আচ্ছা ঠিক আছে -আমি ক্যামেরাম্যান নিয়ে আসছি।–আপনার এবং যার সম্পর্কে এই গুজব রটেছে তার একটা ইন্টারতভ্যু নিতে চাই।
কেন?
গুজবের উপর একটা নিউজ করব।
মীরা টেলিফোন নামিয়ে রেখে খানিকক্ষণ কাঁদলেন। সবচেয়ে ভালো হত এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্ৰয় নেওয়া—তা সম্ভব হচ্ছে না! আফসার সাহেব বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নন। তাঁকে এখান থেকে সরাতে হলে জোর করে সরাতে হবে।
মীরার ডাক্তার ভাই সাৰ্ব্বক্ষণিকভাবেই এ-বাড়িতে আছে। সে আফসার সাহেবের সঙ্গে বেশ ক বার কথা বলার চেষ্টা করেছে। কোনো লাভ হয় নি।
আফসার সাহেব কড়া চোখে তাকিয়েছেন-কোনো জবাব দেন নি। মীরার কথাবাতাঁর জবাব দেওয়াও তিনি ইদানীং বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু রুমী সুমী কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেন।
রুমী বাবার ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে বলল, বাবা, আসব?
আফসার সাহেব বললেন, আয়।
রুমী ভয়ে-ভয়ে ভেতরে ঢুকল।
কেমন আছ বাবা?
ভালো আছি।
তোমাকে এমন বিশ্ৰী দেখাচ্ছে কেন?
দাড়ি-গোঁফ কামাচ্ছি না, কাজেই বিশ্ৰী দেখাচ্ছে।
কামাচ্ছ না কেন বাবা?
ইচ্ছা করছে না।
কোন ইচ্ছা করছে না?
জানি না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে!
বাবা, আমি কি তোমার পাশে বসব?
বস।
রুমী ভয়ে-ভয়ে বসল। বাবার হাতের ওপর হাত রাখল।
বাবা।
কী মা?
সবাই বলছে তুমি নাকি বিড়াল হয়ে গেছ। তুমি কি বিড়াল হয়েছ?