হ্যাঁ, ঠিক বলছেন। আমি বিড়ালের কথা বুঝি। তার পরেও আমার মনে সন্দেহ আছে।
কেন আছে?
বিড়াল এমন সব কথা বলে যা একটি বিড়াল বলবে বলে মনে হয় না।
উদাহরণ দিন।
যেমন ধরুন।–মা-বিড়াল তার বাচ্চাদের জেলি খেতে নিষেধ করছে, কারণ জেলি খেলে দাঁত নষ্ট হবে। কিংবা সে বাচ্চাদের শ্ৰীন ভেজিটেবল খাওয়াতে চাচ্ছে-কারণ তাতে ভিটামিন আছে–
এ ছাড়াও অন্য কোনো কারণ কি ঘটেছে, যার জন্যে আপনার মনে সন্দেহ হচ্ছে-বিড়ালের কথা আসলে বোঝা যায় না?
হ্যাঁ, এ-রকম ব্যাপারও ঘটেছে। আমি ইদানীং রাস্তায় প্রচুর হাঁটাহাঁটি করি। বেশ কয়েক বার বিড়ালের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওরা ম্যাও ম্যাও করেছে, কিন্তু ওদের কোনো কথা আমি বুঝতে পারিনি।
মিসির আলি বললেন, আপনাদের যদি সময় থাকে আমার সঙ্গে একটা বাড়িতে চলুন। ওদের গোটা তিনেক বিড়াল আছে। আমি দেখতে চাই ওদের কথা। আপনি বুঝতে পারেন। কি না।
মীরা বললেন, সেটা কি ঠিক হবে? তাঁরা কী না কী মনে করবেন—
তাঁরা কিছুই মনে করবেন না। আমরা কী জন্যে যাচ্ছি তাও তাঁদের বলা হবে না।
আফসার সাহেব বললেন, আমার বাসায় চলুন। সেখানে তো বিড়াল আছে।
সেই বিড়ালের কথা যে আপনি বুঝতে পারেন তা তো বলেছেন, আমি নতুন বিড়াল নিয়ে পরীক্ষা করতে চাই। অবশ্যি অস্বস্তি বোধ করলে থাক।
না, অস্বস্তি বোধ করছি না। চলুন।
মিসির আলি মজনুর কাছে বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে রওনা হলেন। মজনু ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ করল না। বিরক্ত মুখে বলল, ফিরতে কি দেরি হইব?
হাঁটা, একটু দেরি হবে।
রান্না হইছে। ভাত খাইয়া যান।
না-ভাত এখন খাব না। তুমি একটা ইলেকট্ৰিক মিস্ত্রি ডেকে কলিং বেল লাগিয়ে নিও।
মিসির আলি তাঁর পরিচিত ঐ ভদ্রলোকের বাসায় এক ঘন্টা কাটালেন। তাঁদের বিড়াল তিনটা না, দুটা। একটি অতি বৃদ্ধ। নড়াচড়ার শক্তি নেই। অন্যটি টম ক্যাট। বেশ উগ্র স্বতাবের। এরা অনেক বারই হ্যাঁয়াও হ্যাঁয়াও করল। আফসার সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিড়াল দুটিকে দেখলেন। ওদের কথা শুনলেন, কিন্তু ওরা কি বলছে কিছুই বুঝলেন না।
বাড়ি থেকে বের হয়ে মিসির আলি বললেন, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে বিড়ালগুলির কথা কিছুই বুঝতে পারেন নি। তাই না?
হ্যাঁ। আমি কিছুই বুঝি নি। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন-আমি আমাদের বাসার বিড়ালটার কথা বুঝি খুব ভালো বুঝি।
মিসির আলি বুললেন, আপনি নিজে কি ধরতে পারছেন—আপনার কথায় যুক্তি নেই? আপনি একটিমাত্র বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন, অন্য কোনো বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন না। তা কী করে হয়?
জানি না। কী করে হয়। মিসির আলি সাহেব, আমি খুব কষ্ট আছি। আপনি আমার কষ্ট দূর করুন। এইভাবে কিছুদিন গেলে আমি পাগল হয়ে যাব। আমার ধারণা, ইতোমধ্যে খানিকটা পাগল হয়েছি।
মিসির আলি বললেন, আমি আপনার ব্যাপারটা নিয়ে ক্রমাগত ভাবছি। আমি এখনো তেমন কিছু বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে বুঝতে পারব। রহস্য উদ্ধার হবে।
কি জন্যে মনে হচ্ছে রহস্য উদ্ধার হবে? তেমন কোনো কারণ কি ঘটেছে?
না, তেমন কোনো কারণ ঘটে নি। তার পরেও মনে হচ্ছে। আমার প্রায়ই এরকম হয়। একধরনের ইনট্যুশন কাজ করে।
মিসির আলি হেঁটে-হেঁটে বাসায় ফিরলেন। বাসার সদর দরজা খোলা। মজনু কলিং বেলও লাগায় নি। মিসির আলি ঘরে ঢুকে বড় ধরনের চমক খেলেন-তাঁর ঘর খালি। মজনু সবকিছু নিয়ে ভোগে গেছে ডলার ভাঙিয়ে সাত হাজার টাকা রেখেছিলেন ফটো অ্যালবামের ভেতর–সেই অ্যালবামও নেই। এত ভারি যে মিউজিক সেন্টার—তা-ও নেই। টেবিল-ল্যাম্প, কলিং বোল-তা-ও নেই। শীতবস্ত্রের মধ্যে তাঁর একটা ভালো শাল ছিল-সেটিও নিয়ে গিয়েছে।
তবে রান্না করে গেছে। টেবিলে সুন্দর করে খাবারুদাবার সাজিয়ে রাখা। পানির গ্লাস, একটা পিরিচে। লবণ, কাঁচামরিচ এবং কাটা শসা রান্না হয়েছে কৈ মাছের দোপিয়াজী, একটা ভাজা এবং ডাল।
মিসির আলি হাত ধুয়ে খেতে বসে গেলেন। প্রতিটি আইটেম অসাধারণ হয়েছে। খেতে-খেতেই মনে হল অতি ভদ্র, নিপুণ রাঁধুনি এই ছেলেটির সন্ধান বের করা খুব কঠিন না। এই ছেলে কোনো বিদেশির বাড়িতে আগে কাজ করত। কথাবার্তায় প্রচুর ইংরেজি শব্দ-তা-ই বলে দেয়। ইংরেজি শব্দগুলি খাবারদাবার-সংক্রান্ত। কাজেই ধরে নেয়া যায়। সে বাবুর্চি ছিল। চুরির দায়ে তার চাকরি চলে যায়—কিংবা পুলিশ হয়তো তাকে খুঁজছে। সে সাময়িক আশ্রয় নিতে এসেছিল তাঁর কাছে। ছেলেটি যেবাড়িতে কাজ করত, সেই বাড়ি গুলশান এলাকায়। কারণ কথাবার্তায় সে গুলশান মার্কেটের কথা প্রায়ই বলত। সে বলছিল একটা প্ৰেশার কুকার হলে অনেক রকম রান্না সে রাঁধতে পারবে। গুলশান মার্কেটে প্ৰেশার কুকার পাওয়া যায়।
মজনু এত সব তারি জিনিস নিজের কাছে রাখবে না। যেহেতু বুদ্ধিমান সে, চেষ্টা করবে অতি দ্রুত জিনিসগুলি বিক্রি করে দিতে।
কোথায় বিক্রি করবে? তার পরিচিত জায়গায়। অবশ্যই গুলশান মার্কেটে। কাজেই এখন একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে তিনি যদি গুলশান মার্কেটে চলে যান তাহলে মজনুকে পাওয়া যাবে!
মিসির আলি খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বিছানায় এসে বসলেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বালিশের কাছে একটা পিরচে দু খিলি পান, একটা সিগারেট এবং ম্যাচ রাখা। তিনি পান মুখে দিয়ে সিগারেট ধরালেন এবং মজনুকে ক্ষমা করে দিলেন। এবং তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁর কাছে মনে হল তিনি আফসার সাহেবের রহস্যভেদের কাছাকাছি চলে গেছেন। কিছু জিনিস এখনো জট পাকানো আছে। তবে তা হয়তো-বা খুলে ফেলা যাবে। কয়েকটা ছোটখাটো ব্যাপার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আরো কয়েকটা দিন লাগবে।