আফসার সাহেব হাসিমুখে বললেন, একটা ছবি দেখলাম।
কী দেখলে?
কুকসিনেমা হলে একটা সিনেমা দেখলাম।
হ্যাঁ, সত্যি।
কী নাম ছবির?
ড়াবির সংসার
কী আছে। ছবিতো?
মারামুরি-কাটাকাটি, গান-বাজনা, নাচ-সবই আছে। কিছুই বাদ নেই।
মীরা দীর্ঘ সময় স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বললেন, হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এস। তোমার জন্যে আমরা সবাই না-খেয়ে বসে আছি।
খাবার টেবিলে বসেই আফসার সাহেব বললেন, বিড়ালকে খেতে দিয়েছ?
মীরা শীতল গলায় বললেন, ঐ-সব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
বিড়ালকে কি খাবার দিয়েছ?
হ্যাঁ।
ভালোমতো দিয়েছ?
হ্যাঁ, ভালোমতোই দেওয়া হয়েছে। তুমি ভাত খাও তো!
কেন জানি খেতে ইচ্ছা করছে না। এক গ্লাস দুধ দাও। দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ি।
ভাত সত্যি খাবে না?
না।
মীরা গ্লাসে করে দুধ নিয়ে এলেন। দুধের গ্লাস রাখতে।-রাখতে ইংরেজিতে বললেন, শুনলাম তুমি নাকি চাকরি ছেড়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ। কার কাছে শুনলে?
অফিস থেকে টেলিফোন করে জানিয়েছে।
এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করলে না?
জিজ্ঞেস করা তো অর্থহীন। সিদ্ধান্ত নেব আমি। এই সিদ্ধান্ত তুমি তো নিতে পারবে না।
সংসার চলবে কীভাবে?
অসুবিধা হবে না, চলবে।
এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে! এখন তো আর আট হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পাবে না-দু-কামরার একটা ঘূপটি ঘর নিতে হবে।
নেবা মানুষের দিন তো সব সময় সমান যায় না। এখন আমার দিন খারাপ যাচ্ছে।
আফসার সাহেব দুধের গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালেন। মীরা বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
তোমরা খাওয়া শেষ করে। আমি বারান্দায় বসি।
আমাদের সঙ্গে বাস না।
এখন বসতে ইচ্ছা করছে না। একটু এক-একা থাকি।
বারান্দায় বসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিড়ালটাকে তার বাচ্চা দুটি নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেলঃ আফসার সাহেব কান পেতে রইলেন। হ্যাঁ, বুঝতে পারছেন। কথা বুঝতে তাঁর কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না।
বাচ্চা বিড়াল : মা, স্যার আজ এত দেরি করে বাসায় এসেছেন কেন?
মা :বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোকের কোনো- একটা সমস্যা হয়েছে।
বাচ্চা : কী সমস্যা?
মা : তাঁর স্ত্রী টেলিফোনে কথাবার্তা যা বলছিলেন তাতে মনে হচ্ছে চাকরি নিয়ে সমস্যা। উনি বোধহয় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আমাদের সামনে ভয়াবহ বিপদ।
বাচ্চা: বিপদ কেন?
মা : চাকরি ছেড়ে দিলে তাঁদের টাকা পয়সার সমস্যা হবে। রাতদিন ঝগড়াঝাঁটি হবে! এখন তা-ও মাঝে-মাঝে খাবারটাবার দেয়-তখন তা-ও দেবে না।
বাচ্চা : মা, আজ তো এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো খাবার দিল না।
মা : রাতের খাবার শেষ হোক, তখন দিলে দিতেও পারে।
বাচ্চা : মা, তোমার কি মনে হয় দেবো?
মা : বুঝতে পারছি না-দিতেও পারে। বাচ্চা। খুব খিদে লেগেছে মা।
মা : একটা ইঁদুর মেরে খাওয়াতে পারি-খাবি?
বাচ্চা : না, রান্না-করা খাবার খাব। মা, ওরা আজ কী রান্না করেছে?
মা :সিম দিয়ে কৈ মাছ। মাছের সঙ্গে একটু সিম দিলে ভালো হয়-ভেজিটেবল একেবারেই খাওয়া হচ্ছে না।
বাচ্চা : সিম দিলেও কিন্তু আমি খাব না মা।
মা : এমনিতেই খাওয়া পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর যদি এই যন্ত্রণা তোমরা কর, তাহলে তো মুশকিল! সিম যদি দেয় তাহলে খেতে হবে। সিমে অনেক ভিটামিন।
বাচ্চা : ভিটামিন কী মা?
মা : এইসব তোমরা বুঝবে না। ভিটামিন খুব প্রয়োজনীয় একটা জিনিস।
আফসার সাহেব উঠে পড়লেন। খাবার ঘরে উঁকি দিলেন। বাচ্চাদের খাওয়া হয়ে গেছে। তারা হাত ধুচ্ছে। মীরার খাওয়া এখনো শেষ হয় নি। আফসার সাহেব বললেন, মীরা, তুমি তো আমাকে মিথ্যা কথা বলেছ।
মীরা বললেন, কী, মিথ্যা বললাম?
তুমি বলেছ–বিড়ালদের খাবার দিয়েছ। আসলে দাও নি।
এটা এমন কোনো মিথ্যা না, যার জন্যে তুমি এমন কঠিনভাবে বাচ্চাদের সামনে আমার কাছে কৈফিয়ত তলব করবে।
আমাকে মিথ্যা কথা কেন বললে? কেন বললে, বিড়ালদের খাবার দেওয়া হয়েছে?
তুমি হঠাৎ করে যাতে আপসেট না-হও সে-জন্যেই সামান্য মিথ্যাটা বললাম। তোমার দুশ্চিন্তার কারণ নেই-এক্ষুণি খাবার দিচ্ছি। যদি চাও চেয়ার- টেবিলে দেব। কাঁটা চামচ দেব। সালাদও দেব।
আফসার সাহেব কঠিন কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। মীরা বললেন, তুমি যে অসুস্থ হয়ে পড়ছি, তা কি তুমি বুঝতে পারছি? জীবনে কোনোদিন তুমি নিজের মেয়েদের খাবারের ব্যাপারে কোনো খোঁজ নাও নি-আজ ব্যস্ত হয়ে পড়েছ বিড়াল নিয়ে অকারণে হৈচৈ করছি। তোমার স্বভাব্যচরিত্র বদলে যাচ্ছে। এক-একা সিনেমা দেখে ফুলে। আমরা দুশ্চিন্তা করতে পারি—এটা একবারও তোমার মনে এল না।
সরি।
থাক, সরি বলতে হবে না।
মীরার রাগ বেশিক্ষণ থাকল না। কিছুক্ষণ পরই নরম গলায় বললেন, কিছু মনে করো না। অনেক কড়া কথা বলে ফেলেছি। আমি দেখতে পাচ্ছি। তুমি একধরনের সমস্যার ভেতর দিয়ে যােচ্ছ। তোমার সঙ্গে আরো শান্ত ব্যবহার করা উচিত ছিল, তা করিনি। আমি লজ্জিত। এস, ঘুমুতে এস। ভয় নেই, তোমার বিড়ালকে খেতে দিয়েছি। দুটো আস্ত কৈ মাছ দিয়েছি।
আফসার সাহেব বললেন, সঙ্গে সিম দিয়েছ তো?
সিম?
হ্যাঁ, সিম। বিড়ালের বাচ্চা দুটো গ্ৰীন ভেজিটেবল একেবারেই খেতে চায় না। অথচ ওদের দরকার।
মীরা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলেন। খানিকক্ষণ পর স্বামীর হাত ধরে বললেন, এস, ঘুমুতে এস।
সেই রাতে আফসার সাহেব ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখলেন। ঘুমের মধ্যেই বিকট চিৎকার করতে লাগলেন। মীরা তাঁর গা ঝাঁকাতে-কাকাতে ব্যাকুল হয়ে ডাকতে লাগলেন, কী হয়েছে? এ্যাই, এ্যাই, কী হয়েছে? রুমী সুমীও ঘুম ভেঙে বাবার ঘরে ছুটে এল।