ফজলু রান্না চড়িয়েছে। তার কাছেই দিলাজান। বাবার সঙ্গে নিচুগলায় গল্প করছে, মাঝে মাঝে চুলার খড়ি নেড়েচেড়ে দিচ্ছে। রান্না আজ অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে ফজলুর স্ত্রী অসুস্থ। ফতে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফজলুর দিকে এগিয়ে গেল, আগুনের পাশে বসে সিগারেটটা শেষ করলে ভালো লাগবে।
ফজলু কেমন আছ?
ফতে নিঃশব্দে এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। ফজলু বুঝতে পারে নি বলে ভয়ঙ্কর চমকে গেল। ফতেকে দেখে সে নিশ্চিন্ত হতে পারুল না। চোখে-মুখে ভয়ের ভাবটা থেকে গেল। শুকনো গলায় বলল, জে ভালো আছি। আপনের সাইল ভালো। এই বলেই সে ফতে যাতে দেখতে না পায় এমন ভঙ্গিতে মেয়েকে চােখের ইশারা করল—যার অর্থ তুই এখানে থাকিস না। ঘরে ঢুকে যা। মেয়ে বাবার আদেশ পালন করল। ফতে পুরো প্রক্রিয়াটি দেখল। তার চেহারায় কোনো ভাবান্তর হল না। দিলজান যে মোড়ায় বসে ছিল ফতে সেই মোড়াতে বসতে বসতে বলল-কী রান্না হচ্ছে?
ফজলু বিনীত গলায় বলল, গরিবের খাওয়া খাদ্য।
গরিবের খাওয়া খাদ্যটা কী? আমার তো মনে হচ্ছে মাংস রান্না হচ্ছে। ভালো ঘ্রাণ বের হচ্ছে!
দিলজান মাংস খাইতে চায়। কয়েক দিন ধইরা বলতেছে। দুই দিন পরে বিবাহ কইরা শ্বশুরবাড়িতে যাইব। আমার কাছে যে কয়দিন আছে। শখ মিটিয়ে দেই।
বিয়ে ঠিক হয়েছে নাকি?
জে না, তবে এইটা নিয়া চিন্তা করি না। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ আল্লাপাকের ঠিক করা। উনি যেখানে ঠিক করেছেন সেইখানেই হবে।
খারাপ না। আল্লা মেহেরবান-রোজই কাজ পাই। গতির খাটনি কাম–তয় গাছপালার কাম পাইলে ভালো হইত।
গাছপালার কামটা কী?
ফজলু উৎসাহ নিয়ে ঘুরে বসল। আগ্রহের সঙ্গে বলল–ঢাকা শহরে দেখছি রাস্তায় রাস্তায় গাছপালা বেচে। ফুলের গাছ, ফলের গাছ। গাছ বেচতে পারলে ভালো হইত। গাছপালা আমার হাতে খুব হয়।
ফতের সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। সে সিগারেটের টুকরাটা দূরে ফেলে আরেকটা ধরাতে ধরাতে বলল-নার্সারির কাজ খারাপ না, কোনো ফুটপাত দখল করে বসে পড়লেই হয়। তবে ব্যবসাটা কীভাবে হয় জানতে হবে। গাছপালা যোগাড় করতে হবে। আমি এক নার্সারির মালিককে চিনি তার সাথে আলাপ করে দেখতে পারি।
ফজলুর চোখ চকচক করছে। মনে হচ্ছে সে চোখের সামনে দেখছে অসংখ্য গাছপালা সাজিয়ে সে বসে আছে। শহরের লোকজন বড় বড় গাড়ি নিয়ে আসছে। চকচকে নোট বের করে গাছ নিয়ে চলে যাচ্ছে। ফতে বলল-সিগারেট খাবে? ফজলু আনন্দের সঙ্গে বলল, দেন একটা টান দেই।
ফতে সিগারেট দিল। ফজলু চুলা থেকে জ্বলন্ত লাকড়ি বের করে সেই আগুনে সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল—গাছের ব্যবসার খোঁজখবর নিয়েন। আমি কলমের কামও খুব ভালো জানি।
তাই নাকি?
জি। আমরার গেরামের যত তিতকুট বরই গাছ আছে-কলম দিয়া সব বরই মিষ্টি বানায়ে দিছি। আমরার গোরামে আমারে কী ডাকত জানেন ভাইজোন? আমারে ডাকত গাছ ডাকাতর।
তোমার গ্রামের নাম কী?
শুভপুর। বড়ই সৌন্দর্য জায়গা। কপালে নাই বইল্যা থাকতে পারলাম না।
ফতে উঠে পড়ল। রাত বারোটার আগে তাকে বাড়িতে পৌঁছতে হবে। রাত বারোটার সময় মূল গেট বন্ধ হয়ে যায়। দারোয়ান গেটে তালা লাগিয়ে গেটের পাশে বেঞ্চিতে বসে ঘুমাবার আয়োজন করে। তার ওপর নির্দেশ আছে বারোটার সময় গেট বন্ধ হয়ে যাবে। তখন গেট খুলতে হলে মালিকের অনুমতি লাগবে। গেট খোলার সময় তিনি উপস্থিত থাকবেন।
ফতের বেলায় হয়তো এটা হবে না। দারোয়ানের সঙ্গে ভালোই খাতির আছে, তারপরেও বিস্ক নেবার দরকার কী? মামা যদি জেগে থাকে গেট খোলার শব্দে অবশ্যই বারান্দায় এসে দাঁড়াবে। চিলের মতো গলায় বলবে-কে আসল? ও আচ্ছা, বাংলার ছোট লাট সাহেব।
ফতে থাকে তার মামার বাড়ির গ্যারেজে।
মামা গাড়ি কেনেন নি বলে তার গ্যারেজ খালি। তিনি কখনো গাড়ি কিনবেন। এরকম মনে হয় না। দরিদ্র লোকজন যখন টাকা পয়সা করে তখন জমি কেনে, বাড়ি বানায়। কেউ কেউ এক পর্যায়ে গাড়ি কেনার মতো সাহস সঞ্চয় করে ফেলে। আর কেউ কোনোদিনই তা পারে না। বদরুল সাহেব দ্বিতীয় দলের। গাড়ি না। কিনলেও তিনি একটা বেবিট্যাক্সি কিনেছেন। প্রাইভেট সাইনবোর্ড লাগানো বেবিট্যাক্সিতে করে তিনি ঘুরে বেড়ান, তার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখেন।
গ্যারেজে দুটো চৌকি আছে। একটায় ফতে ঘুমায় পাশেরটায় বেবিট্যাক্সির ড্রাইভার বাদল। তবে বেশিরভাগ সময় বাদল তার বাড়িতে চলে যায়। হঠাৎ হঠাৎ বেবিট্যাক্সি চালানোর প্রয়োজন পড়লে ফতে চালায়। তার লাইসেন্স নেই। কিন্তু বেবিট্যাক্সি সে ভালোই চালাতে পারে। যদিও বদরুল সাহেব তার ভাগ্লের বেবিট্যাক্সি চালানোর কোনো ভরসা পান না। সারাক্ষিণ টেনশনে থাকেন। সারাক্ষণ উপদেশ দিতে থাকেন–এই গাধা আস্তে চালা। এই গাধা তোর ওভারটেক করার দরকার কী? তোর কি হাগা ধরেছে? হর্ন দেস না কেন? হর্ন না দিলে রিকশাওয়ালা বুঝবে কী করে তার পিছনে বেবিট্যাক্সি? রিকশাওয়ালার মাথার পিছনে কি চক্ষু আছে?
বাসায় পৌঁছেই ফতে দেখে উঠানে জটিল। তার মামা ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছেন। ফতেকে দেখেই তিনি ধমক দিয়ে উঠলেন-রাত বারোটা বাজে তুই ছিলি কোথায়? মদ ধরেছিস নাকি? মদের আখড়ায় ছিলি? গা দিয়ে তো মদের গন্ধ বের হচ্ছে। মাল টেনে এসেছিস?
ফতে জবাব দিল না। উত্তপ্ত মুহূর্তে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরে নীরব থাকতে হয়। মামা অতি উত্তপ্ত।