লুনা কেমন লাগল?
লুনা হাসল, কিছু বলল না।
শুধু হাসলে হবে না, মুখে বল ভালো। বল, ভালো।
ভালো।
এখন বল আমি লোকটা কেমন?
লুনা আবার হাসল।
আরেকটা আইসক্রিম খাবে?
হুঁ।
ফতে দুটা আইসক্রিম কিনল। একটা তার জন্যে একটা লুনার জন্যে। লুনা নিজে আইসক্রিম খেলে যত খুশি হয় বড় কাউকে আইসক্রিম খেতে দেখলে তার চেয়েও বেশি খুশি হয়। লুনাকে খুশি রাখা ফতের প্রয়োজন। খুশি রাখা না পোষ মানিয়ে ফেলা। এই কাজটা মনে হয় খুব সহজ-আসলে খুব কঠিন। বড়দের পোষ মানানো সহজ, শিশুদের পোষ মানানো কঠিন! ভয়ঙ্কর কঠিন। কারণ শিশুরা অনেক কিছু বুঝতে পারে-বড়রা পারে না।
লুনার ব্যাপারটা ভিন্ন। সে শিশু হলেও জড়বুদ্ধির কারণে অনেকটাই পশুর মতো। খাবার দিয়ে, মিথ্যা মমতা দিয়ে পশুদের পোষ মানানো যায়। যে কসাই গরু জবেহা করবে সে যদি গরুটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় গরু তাতে আনন্দ পায়। চোখ বন্ধ করে লেজ নেড়ে আদর নেয়। আদরের সত্যি মিথ্যা ধরতে পারে না।
লুনা আরেকটা আইসক্রিম খাবে?
লুনা আবারো ইঠা সূচক মাথা নাড়ল। আবার তার চোখ চকচক করে উঠল।
ফতে আকারো আইসক্রিম কিনল। এই মেয়েটা পোষ মেনেই আছে। পোষ মানানোটা আরো বাড়াতে হবে। মেয়েটাকে নিয়ে তার কিছু পরিকল্পনা আছে।
লুনা বাসায় যাবে?
না।
চল আজ বাসায় চলে যাই। খুব তাড়াতাড়ি আবার বেড়াতে আসব। তখন আর বাসায় ফিরব না। আচ্ছা?
লুনা মনের আনন্দে ঘাড় কাত করল।
ফতে যে তিন ঘণ্টা লুনাকে নিয়ে ঘুরে এসেছে ব্যাপারটা প্রকাশিত হল না। তসলিমা বেগমের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে ফতে নিজের কাজে বের হল। দোকানটা ঠিক করতে হবে। সাইনবোর্ড বানাতে হবে। হঠাৎ হঠাৎ দোকানে থাকতে হতে পারে। তার জন্যে বিছানা-বালিশ লাগবে। মশারি লাগবে। তার নিজের জন্যেও বাসা ভাড়া করা দরকারী।
বুড়িগঙ্গায় বাড়ি ভাড়ার মতো নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। নৌকার ভেতর ঘুমানোর ব্যবস্থা। নৌকার ভেতরই রান্নাঘর, বাথরুম। দুমাস, তিন মাসের জন্যে একটা নৌকা ভাড়া করে ফেলা যায়। স্থায়ী বাড়ির চেয়ে লীকা বাড়ি অনেক ভালো। যেখানে সেখানে নৌক নিয়ে যাওয়া যায়। কয়েকটা নৌকাওয়ালার সঙ্গে ফতের আলাপ হয়েছে। পছন্দসই নৌকা পাচ্ছে না। তাড়াহুড়া করে একটা নৌকা নিয়ে নিলেই হবে না। কোনো কিছু নিয়েই তাড়াহুড়া করা ঠিক না। আল্লাহপাক কোরান শরিফেও বলেছেন–হে মানব সস্তান, তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া। ফতে তাড়াহুড়ায় বিশ্বাস করে না।
রাত এগারোটা বাজে। ফতে বসে আছে তাদের বাসার পেছনে মিউনিসিপ্যালিটির ফ্ৰকা জায়গাটিার ভেতরে কংক্রিটের এক চেয়ারে। জায়গাটিার নাম–শিশু বিনোদন পার্ক। এই নামে ক্ৰীড়া প্রতিমন্ত্রী জায়গার উদ্বোধন করেছেন। শ্বেতপাথরের একটি ফলকে এই বিশেষ ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে। উদ্বোধনের দুদিন আগে তড়িঘড়ি করে কয়েকটা লম্বা চেয়ার বসানো হয়েছে। একটা স্নাইড এবং দুটা সি-সো। একটা দোলনা আনা হয়েছে, বসানো হয় নি। যেহেতু উদ্বোধন হয়ে গেছে এখন আর বসানোর তাড়া নেই। জিনিসগুলি রোদে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে। দোলনাটা অবিশ্যি কিছু কাজে লাগছে। দোলনার খুঁটিতে দড়ি লাগিয়ে পলিথিন ঝুলিয়ে গ্রাম থেকে আসা একটা পরিবার সুন্দর সংসার পেতে ফেলেছে।
ফতে এই পরিবারটিকে শুরু থেকেই লক্ষ করছে। বাবা-মা, তেরো-চৌদ্দ বছরের একটা বড় বড় চোখের রোগা মেয়ে। এরা দিশাহারা ভঙ্গিতে একদিন পার্কে ঢুকল, ফতে তখন বেঞ্চিতে বসে বাদাম খাচ্ছে। লক্ষ্য রাখছে পরিবারটি কী করে। স্বামী-স্ত্রী নিচুগলায় কিছুক্ষণ কথা বলল। লোকটি এগিয়ে এল ফতের দিকে। ভিক্ষা চাইতে আসছে না এটা বোঝা যাচ্ছে। গ্রাম থেকে যারা আসে তারা এসেই ভিক্ষা করা শুরু করতে পারে না। সময় লাগে।
ভাইসাব এইটা কি সরকারি জায়গা?
লোকটা খুবই বিনীত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছে। তার স্ত্রী ও কন্যা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ফতে বলল, হ্যাঁ, এটা মিউনিসিপালটির জায়গা।
সরকারি জাগোত আমরা যদি থাকি কোনো অসুবিধা আছে?
কোনো অসুবিধা নাই–থাকেন।
আমরা এই পরথম ঢাকা শহরে আসছি। কাজের ধান্দায় আসছি।
ভালো করেছেন।
এই জায়গাটা কি নিরাপদ?
আপনার এবং আপনার স্ত্রীর জন্যে নিরাপদ। আপনাদের মেয়ের জন্যে নিরাপদ না। একদিন দেখবেন মেয়ে নাই।
লোকটা ভীত মুখে তাকিয়ে রইল। ফতে বলল, মেয়ের নাম কী?
মেয়ের নাম দিলজান।
দিলজানকে বাকির খাতায় ধরে সংসার পাতেন কোনো সমস্যা নাই। আপনার দেখাদেখি আরো অনেকে উঠে আসবে। সুন্দর একটা বস্তি তৈরি হয়ে যাবে। আপনাদের সাহায্যের জন্যে এনজিওরা আসবে। সুন্দর সুন্দর স্মার্ট মেয়েরা ভিটামিন এ ট্যাবলেট দিয়ে যাবে। বয়স্করা স্কুলে ভর্তি হবে। নানান রকম পরীক্ষা হবে।
কী বলতেছেন কিছু বুঝতেছি না জনাব।
বোঝবার কিছু নাই। সংসার পাততে চান-পাতেন। নেন সিগারেট নেন।
লোকটা একবার সিগারেটের দিকে তাকাচ্ছে একবার তার কন্যার দিকে তাকাচ্ছে। অপরিচিত মানুষের থেকে সিগারেট নেওয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। আবার আস্ত সিগারেটের লোভও ছাড়তে পারছে না। শেষ পর্যন্ত লোভ জয়ী হল-সে সিগারেট নিয়ে চলে গেল।
ফতে ফজলু মিয়ার পরিবারের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে প্রায় মুগ্ধ হয়ে গেল। তারা অতিদ্রুত সংসার সাজিয়ে ফেলল। প্রথম দিনেই লোকটির স্ত্রী চুলা বানিয়ে ফেলল-চুলার আশপাশের কিছু অংশ লেপে ফেলল। সেখানে একটা মোড়া এবং কাঠের খুঁড়ি চলে এল। এক রাতে দেখা গেল চুলার উপরে কাপড় শুকানোর মতো করে লম্বা করে তার টানানো হয়েছে। সেই তারে মাছ শুকানো হচ্ছে। লোকটিও চালাক-ঠেলা চালানোর কাজ যোগাড় করে ফেলল। দিনের বেলা ঠেলা চালায়, রাতে এক চায়ের দোকানের এসিসটেন্ট। মেয়েটিকে নিয়ে এখনো তাদের কোনো সমস্যা হয় নি। তবে তারা এখন এক না, আরো চার-পাঁচটি পরিবার চলে এসেছে। এখন নিশ্চয়ই তাদের খানিকটা জোর হয়েছে।