ফতের মামার কথাই ধরা যাক। ফতের মামা বদরুল সাহেব নিশ্চয়ই কখনো ফতেকে ভালোভাবে দেখেন নি। তিনি নিশ্চয়ই ফতের মানসিকতা, তার চিন্তাভাবনা কিছুই বলতে পারবেন না। ফজরের নামাজ শেষ করে ফতে মর্নিং ওয়াক করতে যায় এই তথ্য তিনি জানেন। কিন্তু কোথায় যায় তা কি জানেন? তিনি কি জানেন যে ফতের অনিদ্রা রোগ আছে, সে মাঝে মাঝে অনেক রাত পর্যন্ত ছাদে হাটে। এই কাজটা যখন করে সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে; ফতের মামা কি জানেন যে ফতে বাজারের ভারী ব্যাগ নিয়ে যখন ঢোকে তখন ব্যাগটা থাকে তার বা হাতে। বী হাতি মানুষরা এই কাজ করে। ফতে বা হাতি না। তারপরেও ভারী কাজগুলি সে বাঁ হাতে করে; ডান হাত ব্যবহার করে না।
মিসির আলি চিন্তা বন্ধ করে হঠাৎ নিজের ওপর খানিকটা বিরক্তি বোধ করলেন। ছেলেমানুষ এই কাজটা তিনি কেন করছেন? কেন প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে তাঁর পৰ্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো। এটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। যার পড়াশোনার বিষয় মানুষের মন তাকে তো মানুষ পর্যবেক্ষণ করতেই হবে। মানুষের দিকে তাকিয়ে তুর আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করে পৌঁছতে হবে মন নামক অথরা বস্তৃত। আচ্ছা মন কী?
মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। উত্তরটা আঁর জানা নেই। গত পঁচিশ বছর এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছেন। উত্তর পান নি। এখন বয়স হয়ে গেছে। যে কোনো একদিন অদ্ভুত ট্রেনে উঠে পড়তে হবে। ট্রেনে উঠার আগে কি উত্তরটা জেনে যাওয়া যাবে না?
বাড়িওয়ালা বদরুল সাহেবের মেয়েটা কঁদছে। শিশুরা ব্যথা পেয়ে যখন কাঁদে তখন কান্নার আওয়াজ এক রকম, আবার যখন মনে কষ্ট পেয়ে কঁদে তখন অন্য রকম। লুনা মেয়েটার কান্না শুনে মনে হচ্ছে সে গভীর দুঃখে কাঁদছে।
মেয়েটা প্রায়ই এরকম কাঁদে। তখন কিছুতেই তার কান্না থামানো যায় না। বদরুল সাহেব কোলে নিয়ে হাঁটেন। তার স্ত্রী হাঁটেন। আদর করেন, ধমক দেন। কিছুতেই কিছু হয় না। একটা পৰ্যায়ে তারা মেয়েকে ফতের কাছে দিয়ে দেন। ফতে কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত করে ফেলে।
অনেকক্ষণ ধরেই মেয়েটা কান্দছে; মিসির আলি বই বন্ধ করে বসে আছেন। বাচ্চা একটা মেয়ে গভীর দুঃখে কঁদিবে। আর তিনি তা অগ্রাহ্য করে স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে যাবেন-তা কীভাবে হয়?
তিনি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এস। দাঁড়ালেন। লুনাকে নিয়ে তার মা দোতলার বারান্দায় রেলিং ঘেঁষে হাঁটছেন। এত দূর থেকেও ভদ্রমহিলাকে ক্লান্ত এবং হতাশ মনে হচ্ছে।
মিসির আলি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকলেন। লুনার কান্নাটা সহ্য করা যাচ্ছে না। তাঁর বিরক্তি লাগছে। কেন মেয়েটার বাবা-মা ফতেকে ডাকছেন না। ফতে নিমিষের মধ্যেই বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
বাচ্চা মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। কেঁদেই যাচ্ছে।
লুনাকে সামলে রাখার দায়িত্ব
লুনাকে সামলে রাখার দায়িত্ব পড়েছে ফতের ওপর।
প্রতি মাসে এক-দুদিন ফতেকে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়। কারণ প্রতি মাসে এই এক-দুদিন তসলিমা খানম যাত্রাবাড়ীতে তার বোনকে দেখতে যান। বোনের ক্যানসার হয়েছে। বাঁচার কোনো আশা ডাক্তাররা দিচ্ছেন না, আবার দ্রুত মরে গিয়ে অন্যদের ঝামেলাও কমাচ্ছে না?
তসলিমার অনুপস্থিতিতে ফতে লুনার দিকে লক্ষ রাখে। তাকে বলা আছে একটা সেকেন্ডের জন্যেও যেন মেয়েকে চোখের আড়াল না করে। ফতে তা করে না। সে লুনার আশপাশেই থাকে। লুনা এমনই লক্ষ্মীমেয়ে যে কোনো কান্নাকাটি করে না। খাবার সময় হলে শান্ত হয়ে ভাত খায়। সে শুধু রাতে কাঁদে। মেয়েটির আঁধারভীতি আছে।
লুনা বারান্দায় বসে আপনমনে খেলছে। হাতের মুঠি বন্ধ করছে, খুলছে। খুব ক্লান্তিকর খেলা কিন্তু ফতের দেখতে ভালো লাগছে।
ফতে ডাকল, লুনা। এই লুনা। লুনা ফতের দিকে তাকিয়ে হাসল। আবার খেলা শুরু করল। ফতে বলল, লুনা কী করে?
লুনা তার হাতের মুঠি থেকে চোখ না তুলেই বলল, খেলি। এই খেলার নাম কী?
জানি না।
মা কোথায় গেছে। লুনা?
জানি না।
মা কোথায় গেছে আমি জানি। সে প্রতি মাসে দুই-তিন দিন কোথায় যায় সেটা আমি জানি। বোনকে দেখতে যাবার নাম করে যায়। বোনকে দেখতে ঠিকই যায়। বোনের কাছে দশ-পনেরো মিনিট, খুব বেশি হলে আধঘণ্টা থাকে। বাকি সময়টা কোথায় থাকে। আমি জানি।
লুনা ফতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে মিষ্টি করে হাসল।
ফতে বলল, তোমার মা কোথায় যায় আমি জানি। কীভাবে জানি বলব?
লুনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ফতে হতাশ মুখে বলল, কীভাবে জানি বললে তুমি বুঝবে না। এই জন্যে বলব না। অবিশ্যি বুঝতে পারলেও বলতাম না।
ফতে লুনার মতো খেলা নিজেও খেলতে শুরু করল। লুনা তাতে খুব মজা পাচ্ছে! খিলখিল করে হাসছে।
আইসক্রিম খাবে?
লুনা খুশি হয়ে মাথা নাড়ল।
ফতে বলল, চল আইসক্রিম খেয়ে আসি।
লুনা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। তার চোখ চকচক করছে। এর আগেও সে ফতের সঙ্গেই কয়েকবার চিড়িয়াখানায় গিয়েছে। লুনাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে এক পাও যাবার অনুমতি নেই। তারপরেও ফতে লুনাকে নিয়ে পঁচি থেকে ছবার চিড়িয়াখানায় গিয়েছে। কেউ কিছু ধরতে পার নি। কাজের মেয়েটা কিছু বলে দেয় নি, আবার দারোয়ানও নালিশ করে নি। ফতে নিশ্চিত আজো কেউ কিছু ধরতে পারবে না। চিড়িয়াখানা যাওয়া, চিড়িয়াখানা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা সব মিলিয়ে তিন ঘণ্টার মামলা।
ফতে লুনাকে শুধু যে চিড়িয়াখানা দেখাল তা-না-এয়ারপোর্ট নিয়ে গিয়ে প্লেন ওঠানামা দেখাল। এটা ফতের নিজের খুব পছন্দ। বিরাট একটা জিনিস কেমন করে শা করে আকাশে উড়ে যাচ্ছে।