আপনার কাছ থেকে কোনো কথাই প্ৰকাশ হবে না। আপনি গাছের মতো। গাছের কাছ থেকে কোনো কথা প্রকাশ হয় না।
আমাকে কথাগুলি বলার কারণ কী?
কাউকে বলার ইচ্ছা করছিল। আমার স্যার কথা বলার লোক নাই। বাবা-মা শৈশবে গত হয়েছেন। একটা বোন আছে মাথা খারাপ। বন্ধুবান্ধব কেউ নাই!
কাউকে বলতে হয় বলেই কি তুমি আমাকে কথাগুলি বললে?
জি স্যার।
কারেন্ট চলে এসেছে। ফতে ফু দিয়ে বাতি নিভিয়ে উঠে দাঁড়াল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, স্যার যাই। আমার জন্যে একটু দোয়া রাখবেন স্যার। গরিবের ছেলে যদি দোকানটা দিয়ে কিছু করতে পারি। আরেকটা ছোট্ট অনুরোধ। যদি রাগ না করেন তা হলে বলি।
বল।
দরজির দোকানের একটা নাম যদি দেন। সুন্দর কোনো নাম। আগে নাম ছিল বোম্বে টেইলারিং হাউস। আমি স্যার সুন্দর একটা নাম দিতে চাই। বাংলা নাম।
নামটাম আমার ঠিক আসে না।
আপনি যে নাম দিবেন। সেটাই আমি রাখব। আপনি যদি খারাপ নামও দেন কোনো অসুবিধা নাই। আপনি যদি নাম দেন-গু-গোবর টেইলারিং শপ আল্লাহর কসম সেই নামই রাখব।
কেন?
এটা আমা একটা শখ। মানুষের অনেক শখ থাকে। আমার শখ আমার দরজির দোকানোর নামটা আপনি দিবেন।
আচ্ছা দেখি মাথায় কোনো নাম আসে কি না।
এত চিন্তাভাবনা করার কিছু তো নাই। সার। এখন আপনার মাথায় যে নামটা আসছে সেটা বলেন।
এখন মাথায় কিছু নেই।
যা ইচ্ছা বলেন।
সাজঘর।
আলহামদুলিল্লাহ। আমার দোকানের নাম সাজঘর। স্যার উঠি?
আচ্ছা।
ফতে বিনীত গলায় বলল, দুটা মোমবাতি আর একটা দেয়াশলাইয়ের দাম পড়েছে পােচ টাকা। আপনার কথা ভেবে কিনেছিলাম। ভাংতি পাঁচ টাকা কি আছে স্যার?
মিসির আলি ড্রয়ার খুলে পাচ টাকার একটা নোট বের করলেন। ফতের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনে তিনি যতটা না অবাক হয়েছেন তারচে অনেক বেশি অবাক হয়েছেন। পাঁচ টাকার ব্যাপারটায়।
ফতে চলে গেল। যাবার আগে অতি বিনয়ের সঙ্গে মিসির আলিকে কদমবুসি করল। মিসির আলির মনে হল তিনি ছোট্ট একটা ভুল করেছেন। চলে যাবার আগে ফতেকে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন ছিল—কটা বাজে? ঘুমাতে যাবার আগে সময়টা জানা থাকা দরকার। আধুনিক মানুষ যন্ত্রনির্ভর হয়ে গেছে। মানুষ যেমন যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে, যন্ত্রও মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছে।
মিসির আলি দরজা বন্ধ করে ঘুমাতে গেলেন। ভালো শীত লাগছে। কোন্ড ওয়েভ হচ্ছে কি না কে জানে। কোন্ড ওয়েডের বাংলাটা ভালো হয়েছে-শৈত্যপ্রবাহ। কিছু কিছু শব্দ এমন আছে যে বাংলাটা সুন্দর-ইংরেজি তত সুন্দর না। যেমন Air condition বাংলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ। বায়ু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না।–তাপ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
জানোলা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। তিনি পায়ের ওপর চাদরটা দিয়ে দিলেনতখনই মনে পড়ল চাদরটা যে তাকে উপহার দিয়েছিল তার নাম তিনি মনে করতে পারছেন না। শুধু নাম না, মানুষটার পরিচয়ও তার মনে নেই। মস্তিষ্ক মানুষটার পরিচয় মুছে ফেলেছে। মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে এ ধরনের কাজ করে। খুব ঠাণ্ডায় মাথার বিশেষ বিশেষ কিছু স্মৃতির দরজা বন্ধ করে দেয়। মস্তিষ্ক মনে করে এই কাজটি করা প্রয়োজন, দরজা বন্ধ না করলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হবে। এমন কোনো পদ্ধতি কি আছে যাতে এই বন্ধ দরজা খোলা যায়?
কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের কিছু কিছু ফাইল হঠাৎ হারিয়ে যেতে পারে। সেই সব ফাইল উদ্ধারের প্রক্রিয়া আছে। মানুষের মস্তিষ্ক তো অবিকল কম্পিউটারের মতোই। স্মৃতি তো কিছু না সাজিয়ে রাখা ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল! কাজেই যে পদ্ধতিতে কম্পিউটারের হারানো ফাইল খোঁজা হয়-সেই পদ্ধতিতেই বা তার কাছাকাছি পদ্ধতিতে হারানো স্মৃতি খোঁজার চেষ্টা কেন হচ্ছে না?
মিসির আলি হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে বই নিলেন। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর মন যে কোনো কারণেই হোক কিছুটা বিক্ষিপ্ত। মনকে শান্ত করতে না পারলে রাতে ভালো ঘুম হবে না। মন শান্ত করার একটি পদ্ধতিই মিসির আলি জানেন। বই পড়া। সেই বইও হালকা গল্প-উপন্যাস না, থ্রিলার না, জটিল কোনো বিষয় নিয়ে লেখা বই। তিনি যে বইটি হাতে নিলেন তার নাম-Dark days. অন্ধকার দিন। লেখক এই পৃথিবীর ভয়াবহ কয়েকজন অপরাধীর একজন, নাম-David Bertzowitz, তার লেখা আত্মজীবনী। তিনি লিখেছেন–
I have often noticed just how unobservant people are. It has been said that parents are the east to know. This may be true in my case, for wonder how I at the ages of nine, eleven, thirteen manged to do so many negative things and go unnoticed. It is puzzling indeed. And I think it is sad.
আমি প্রায়ই লক্ষ করেছি মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভালো না। বলা হয়ে থাকেবাবা-মারা সবার শেষে জানতে পারেন। আমার জন্যে এটা সত্যি। আমি খুবই অবাক হই যখন ভাবি ন বছর, এগারো বছর এবং তেরো বছরে যেসব অন্ধকার কর্মকাণ্ড আমি করেছি তা কী করে কারোর চোখে পড়ল না। চোখে না পড়ার বিষয়টা রহস্যময় এবং অবশ্যই দুঃখের।
মিসির আলি লক্ষ করলেন তার মন শান্ত হয়েছে। মন নানান দিকে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছিল। একসঙ্গে অনেকগুলি পথে হাটছিল–এখন একটি পথে হাঁটছে। বইটির বিষয়বস্তুতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। David Bertzowitz ঠিকই লিখেছে মানুষের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নিম্নমানের। সে দেখেও দেখে না।