এগারোটা পাঁচ।
তোমার হাতে ঘড়ি আছে?
জি না।
আমার এখানে আসার আগে কি ঘড়ি দেখে এসেছ?
জি না।
তা হলে কী করে বলছ-এগারোটা পাঁচ বাজে?
ঘড়ি না দেখেও আমি সময় বলতে পারি। ছোটবেলা থেকেই পারি। মৃত্যুঞ্জয় হাই স্কুলে যখন পড়ি তখন স্কুল পরিদর্শনে ইন্সপেক্টর সাহেব এসেছিলেন, তাকে ঘড়ির খেলা দেখিয়েছিলাম। উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাকে একটা ভালো ঘড়ি পাঠিয়ে দেবেন। পাঠান নাই। ভুলে গেছেন হয়তো।
ঘড়ির খেলাটা কী?
ঘড়ি না দেখে বলা সময় কত।
ও আচ্ছা।
স্যারের শরীর কি খারাপ?
সামান্য খারাপ।
শরীরের যত্ন নিবেন স্যার। যত্ন বিনা কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। এই আমাকে দেখেন সকালে ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হই। চাইর থেকে পাচ মাইল হাঁটি। এই কারণে আমার কোনো অসুখবিসুখ হয় না। আপনে যদি অনুমতি দেন সকালে হাঁটতে যাবার সময় আপনাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে যাব।
কোনো দরকার নেই ফতে মিয়া। হাঁটাহঁটি ব্যাপারটা আমার পছন্দ না। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ নানান কষ্টকর পদ্ধতির ভিতর দিয়ে যায়-ব্যায়াম করে, হাঁটাহঁটি করে। আমার দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার কোনো বাসনা নেই।
কথা শেষ করার আগেই কারেন্ট চলে গেল। ফতে মিয়া বলেছিল দশ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে। তাই হয়েছে। চমকানোর মতো কোনো ঘটনা না। ঢাকা শহরে রাতে পঁচ-ছবার করে ইলেকট্রসিটি চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে কেউ যদি বলে দশ মিনিটের মধ্যে লোডশেডিং হবে তার কথা সত্যি হবার সম্ভাবনাই বেশি। মিসির আলি ভেবেছিলেন ফতে বলবে, দশ মিনিটের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে বলেছিলাম দেখলেন। সার কারেন্ট চলে গেছে।
ফতে তা করুল না। সে সাবধানে মোমবাতি জ্বালাল। পাশাপাশি দুটা মোমবাতি। তার মুখ হাসি হাসি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে সে আনন্দিত। ফ্লাস্ক থেকে নিজের জন্যে চা ঢালতে ঢালতে বলল, স্যার আজ আমার মনটা খুব ভালো।
ভালো কেন?
আমি একটা দোকান নিয়েছি। সেলামির টাকা ছাড়াই দোকান পেয়েছি। আঠারো হাজার টাকা শুধু দিতে হয়েছে।
কিসের দোকান?
সরজির দোকান। আমি দরজির কাজ কিছু জানি না। ইনশাল্লাহ শিখে ফেলব। তবে একজন কর্মচারী আছে। কাজ ভালো জানে। দোকান নেওয়ার খবরটা স্যার আপনাকেই প্রথম দিলাম। আপনি নাদান ফতের জন্যে খাস দিলে একটু দোয়া করবেন।
ফতের চোখ চকচক করছে। গলার স্বর ভারী হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে সে কেঁদেই ফেলবে। ফতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দোকানের টাকাটা খুবই কষ্ট করে যোগাড় করেছি। মামার সঙ্গে দুবছর ধরে আছি। এই দুবছরে মামার বাজার করতাম। রোজ কিছু কিছু টাকা সরাতাম। কোনোদিন দশ টাকা কোনোদিন পনেরো টাকা। এই অনেক টাকা হয়ে গেল-ঐ কবিতাটা পড়েছেন না। স্যার বিন্দু বিন্দু বালিকণা বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তুলে সাগর অতল। দৈনিক পনেরো টাকা সরালে দুই বছরে হয় দশ হাজার নয়শ পঞ্চাশ টাকা। আমার হয়েছে সাড়ে নয়। হাজার টাকা। কিছু টাকা খরচ করে ফেলেছি। আমার আবার সিগারেট খাওয়ার বদভ্যাস আছে। নেশার মধ্যে সিগারেট আর জারদা দিয়ে পান। স্যার নেন আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নেন। বাংলা ফাইত।
মিসির আলি সিগারেট নিলেন। ফতে আবারো কথা শুরু করুল-একবার করুলাম কি স্যার বেশ কিছু টাকা একসঙ্গে সরিয়ে ফেললাম। পঁচিশ হাজার টাকা। আমাকে ব্যাংকে পাঠিয়েছে জমা দিতে, আমি ফিরে এসে বললাম টাকা হাইজ্যাক হয়ে গেছে। মামা-মামি দুজনই আমার কথা বিশ্বাস করল। বিশ্বাস না করে উপায়ও নাই-আমার হাত-পা কাটা সারা শরীর রক্তে মাখামাখি।
নিজেই নিজের হাত-পা কেটেছ?
জি স্যার। একটা ব্লেড কিনে, ব্লেড দিয়ে কেটেছি। নিজের হাতে নিজের শরীর কাটাকুটি করা খুবই কষ্টের কিন্তু কি আর করা এতগুলি টাকা। এত রক্ত বের হচ্ছিল যে আমার মামি পর্যন্ত মামার উপরে রেগে গিয়ে বলল-কেন তুমি তাকে একা একা এতগুলি টাকা দিয়ে পাঠালে! একে তো মেরেই ফেলত। স্যার আমার কথা শুনে কি আপনার খারাপ লাগছে?
মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি আগ্রহ নিয়ে কথা শুনছেন। ফতের গল্প বলার ক্ষমতা ডালো। গলার স্বরের উঠানামা আছে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ কথা বন্ধ করে। রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসে। এতে গল্পটা আরো জমে যায়।
স্যার বোধহয় আমাকে খুব খারাপ মানুষ ভাবছেন! স্যার আমি খারাপ না। মামার কাছ থেকে আমি কত টাকা নিয়েছি। সব একটা খাতায় লিখে রেখেছি। ইনশাল্লাহ সব টাকা একদিন ফিরত দেব।
দরজির দোকান দেওয়ার ব্যাপারটা তোমার মামা জানে?
জি স্যার আজ বিকালে বলেছি।
উনি জিজ্ঞেস করেন নাই এত টাকা কোথায় পেয়েছ?
উনাকে বলেছি যে আমার এক বন্ধু আমাকে টাকাটা ধার দিয়েছে।
বন্ধুর কথা উনি বিশ্বাস করেছেন?
জি করেছেন। উনি জানেন আমার এক বন্ধু কুয়েতে কাজ করে। বাবুর্চি। সে আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে। এটা মামাকে অনেক দিন থেকেই বলছিলাম। মামা এটা নিয়ে আমাকে অনেক ঠাট্টা-মশকরাও করতেন। প্রায়ই বলতেন-কই তোর বন্ধুর টাকা কবে অ্যাসবে?
আজ সন্ধ্যায় মামাকে পা ছুঁয়ে বলেছি টাকা এসেছে। মিষ্টি কিনে নিয়ে গিয়েছি। মামা খুশি হয়েছে। দরজির দোকানের কথা মামাকে বলেছি। মামা বলেছেন প্রয়োজনে তাঁর কাছ থেকে কিছু টাকা নিতে। এটা অবশ্য মামার মুখের কথা। মামা মুখে অনেক কথা বলেন।
ফতে।
জি স্যার।
তুমি আমাকে যেসব কথা বললে তার সবই তো গোপন কথা। প্রকাশ হয়ে পড়লে তোমার সমস্যা। কথাগুলি আমাকে কেন বললে?