জানি না।
লুনা আরেকটা লজেন্স ইয়াসিনের দিকে বাড়িয়ে দিল। ইয়াসিন লজেন্স নিল না। লুনা হাত বাড়িয়েই থাকল। মিসির আলি বুঝতে পারছেন। লজেন্স হাত থেকে না নেওয়া পর্যন্ত এই মেয়ে হাত নামাবে না। মেয়েটা খুবই অসুস্থ। তার মস্তিষ্কের কোনো একটা অংশ জট পাকিয়ে গেছে। এই জন্ট কে খুলতে পারে? এমন কোনো বুদ্ধি যদি থাকত মাথার ভেতর ঢুকে জটি খোলা যেত। মিসির আলির হঠাৎ করে প্রতিমার কথা মনে পড়ল। প্রতিমা কি এই মেয়েটার জন্যে কিছু করতে পারে।
নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেছে। ফতে দরজা খুলে নৌকায় ঢুকেই দরজা বন্ধ করে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে হাসল। মিসির আলির বুক ধক করে উঠল। এই হাসি তো মানুষের হাসি না। এই হাসি পিশাচের। হাসি। ফতে মিসির আলির চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলল-স্যার আপনার তো খুবই বুদ্ধি। বুদ্ধি খাটায়ে বলেন তো-লুনা মেয়েটাকে নিয়ে আমি মাঝনদীতে কেন এসেছি। বলতে পারলে আমি আপনাকে একটা প্রাইজ দিব।
মিসির আলি এখন জানেন ফতে কেন লুনাকে মাঝনদীতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন তার সেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তিনি ফতের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ইয়াসিনকে বললেন, ইয়াসিন তুমি মেয়েটার হাত থেকে লজেন্সটা নাও। লজেন্স না নেওয়া পর্যন্ত সে হাত উঁচু করে রাখবে। ইয়াসিন লজেন্স নিল। লুনা মিষ্টি করে হেসে আবারো লজেন্সের খোসা ছাড়ানোয় মন দিল।
ফতে সিগারেট ধরিয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, স্যার যে কাজটা করতে যাচ্ছি। এই কাজ এর আগে আমি আরো চারবার করেছি।
মিসির আলি বললেন, কেন করেছ?
করতে খুব মজা লাগে স্যার। আমার হাতের কাজ যে দেখে সে খুবই ভয় পায়। কেউ ভয় পেলে আমি খুব সহজে তার মাথার ভিতর ঢুকে পড়তে পারি। অনেক দূর যেতে পারি। তার মাথা লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে পারি। তখন কী যে আনন্দ হয়!
ফতে তুমি যে খুব অসুস্থ একজন মানুষ তা কি তুমি জান?
জানি। তার জন্যে আমার খারাপ লাগে না। আল্লাই আমাকে অসুস্থ করে পাঠিয়েছেন। আমি কী করব।
এক অর্থে তোমার কথা ঠিক। তোমার জিনে কোনো গণ্ডগোল আছে। যে কারণে ভয়াবহ কাণ্ডগুলি হাসিমুখে করছি। তোমার সুস্থ হবার কোনো সুযোগ আছে বলেও আমার মনে হয় না।
আপনার ভয় লাগছে না?
না, ভয় লাগছে না। যে ভয়ঙ্কর ঘটনা তুমি ঘটাবে বলে ভাবছ সেই ঘটনা তুমি ঘটাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না?
ফতে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, স্যার আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই। আমি যে কোনো মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে পারি। এখন আপনার এই কাজের ছেলের মাথার ভেতর আমি ঢুকে বসে আছি। এর পকেটে একটা কাচের বোতল আছে। বোতল ভর্তি নাইট্রিক এসিড। আমি যখনই তাকে বলব–ইয়াসিন বোতলের জিনিসটা মিসির আলি সাহেবের গায়ে ঢেলে দে-সে। গায়ে ঢেলে দেবে।
ফতে ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বলল, কীরে ইয়াসিন ঢালবি না? যে মেয়েটার গায়ে ঢালার জন্যে বোতল ভর্তি এসিড নিয়ে ঘুরছিস সে যখন নেই তখন স্যারের গায়ে ঢালবি। পারবি না?
ইয়াসিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ক্ষীণ স্বরে বলল, পারব।
ফতে বলল, তা হলে বোতলটা পকেট থেকে বের করে মুখটা খুলে রাখ।
ইয়াসিন তাই করল। ফতে হাসতে হাসতে বলল, একটু ভয় ভয় লাগছে না স্যার?
মিসির আলি বললেন, না।
একটুও লাগছে না?
না।
মিসির আলি নিজেও বিস্মিত হচ্ছেন। ভয়ঙ্কর একজন মানুষ তার সামনে বসে আছে অথচ তিনি বিচলিত হচ্ছেন না। প্রচণ্ড ভয়ের কোনো কারণ ঘটলে রক্তে এন্দ্রোলিন নামের এনজাইম প্রচুর পরিমাণ চলে আসে। ভয় কেটে যায়। সেরকম কিছু কি ঘটেছে? তিনি ইয়াসিনের দিকে তাকালেন। এসিডের বোতল হাতে সে শক্ত হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি পুরোপুরি ফতের দিকে। ফতে তাকিয়ে আছে ইয়াসিনের দিকে। মিসির লক্ষ করলেন ফতে যখনই তার দৃষ্টি মিসির আলির দিকে দিচ্ছে–ইয়াসিন তখনই নড়ে উঠছে। তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে ফতে যে দাবি করছে সে মানুষের মাথার ভেতর ঢুকে পড়তে পারে-মাথার ভেতর ঢুকতে তার কি চোখ নামক পথের প্রয়োজন হয়। ইয়াসিন যদি চোখ বন্ধ করে ফেলে তা হলেও কি ফতে তার মাথার ভেতর ঢুকে বসে থাকতে পারবে।
মিসির আলিকে অতিদ্রুত যে কাজটা করতে হবে তা হল ইয়াসিনের হাত থেকে এসিডের বোতলাটা নিয়ে নিতে হবে। মিসির আলি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ডাকলেন–ইয়াসিন!
ইয়াসিন তার দিকে তাকল না। ফতের দিকেই তাকিয়ে রইল। ফতের ঠোঁটের কোণায় ক্ষীণ হাসির রেখা। মিসির আলি দ্রুত চিন্তা করছেন। ফতেকে এক্ষুনি বিভ্রান্ত করতে হবে। চমকে দিতে হবে। মিসির আলি হালকা গলায় বললেন, ফতে শোন তুমি যে ক্ষমতার কথা বলছ এই ক্ষমতা যে আমার নেই তা কী করে বুঝলে?
ফতে চমকে তাকাল।
মিসির আলি বললেন, এস আমার মাথার ভেতর ঢুকে দেখ।
ফতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ তীক্ষ্ণ ও তীব্র। তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। ঠোঁট বেয়ে লালার মতো কিছু গড়িয়ে পড়ল। ফতে মিসির আলির মাথার ভেতর চোকার চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ থেকেই করছে। পারছে না। তার নিজেরই সামান্য ভয় ভয় লাগছে। ভয় পাওয়া ঠিক হবে না। সে ভয় পেলে মাথায় ঢুকতে পারবে না। খুব বেশি ভয় পেয়ে গেলে হয়তো উল্টো ব্যাপার ঘটবে! মিসির আলিই তার মাথায় ঢুকে পড়বেন। ফতে ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগল।
মিসির আলি বললেন, তুমি আমার সঙ্গে যে খেলা খেলতে চেয়েছ। এই খেলোটা খেলতে পারবে না। আমি খেলায় কয়েকটা দান এগিয়ে আছি।