মিসির আলি বললেন, ফতে শোন তুমি এতই স্বাভাবিক আছ যে আমার সন্দেহ হচ্ছে মেয়েটা কোথায় আছে তুমি জন। এবং আমার ধারণা মেয়েটাকে তুমিই সরিয়েছ।
ফতে আবারো মনে মনে বলল, শাবাশ। শাবাশ। আয় দুইজনে একটা খেলা খেলি। বাঘবন্দি খেলা। তুই একটা চাল দিবি। আমিও একটা চাল দিব।
মিসির আলি বললেন, ফতে কিছু একটা বল। চুপ করে আছ কেন? মেয়েটাকে তুমি সরাও নি?
ফতে বলল, গেটে দারোয়ান আছে! লুনাকে নিয়ে গেট থেকে বের হলে দারোয়ান দেখত না?
মিসির আলি বললেন, তোমার গায়ে ভারী চাদর। এই চাদর দিয়ে ঢেকে মেয়েটাকে সরিয়ে নিলে কারোর সন্দেহ করার কিছু নেই। চাদরের নিচ থেকে মেয়েটাও কোনো শব্দ করবে না। কারণ সে তোমাকে খুব পছন্দ করে। তাকে চাদরের নিচে ঢুকিয়ে তুমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছ এই দৃশ্য আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি।
ফতে মনে মনে বলল, তুই বাঘবন্দি খেলা খেলতে চাস, আয় খেলি। তুই তিনচারটা ভালো চাল দিয়ে ফেলেছিস। আমি কোনো চাল দেই নাই। এখন দেব।
মিসির আলি বললেন, ফতে কথা বল। চুপ করে থেক না। বাচ্চা মেয়েটাকে তুমি সরিয়েছ?
জি।
মেয়েটা কোথায় আছে?
খুব ভালো জায়গায় আছে, স্যার কোনো সমস্যা নেই। আপনি এত দুশ্চিন্তা কইরেন না। স্যার। নেন একটা সিগারেট খান।
তুমি এই কাজটা কেন করলে?
ফতে হেসে ফেলে বলল, মামা করতে বলেছে। এই জন্যে করেছি।
বদরুল সাহেব বলেছেন?
জি। মামার হুকুমে লুনাকে এক বাসায় রেখে এসে এমন ভাব করতেছি যেন আমি খুব পেরেশান হয়ে খুঁজতেছি।
মিসির আলি বললেন, তোমার মামা এই কাজটা কেন করছেন?
ফতে হাই তুলতে তুলতে বলল, মামিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে কাজটা করেছেন। মামি এই বাচ্চাটাকে মাঝে মাঝে মারে। এটা মামার ভালো লাগে না। অসুস্থ একটা বাচ্চা। একে তার মা মারবে কেন? এই জন্যে মামা ঠিক করেছে। লুনাকে তিন-চার ঘণ্টা লুকিয়ে রাখবে-যাতে মামি বুঝতে পারে সন্তান কী জিনিস। ঘটনাটা কি এখন বুঝেছেন স্যার?
হ্যাঁ বুঝেছি। বাচ্চাটা আছে কোথায়?
বুড়িগঙ্গা নদীতে-নৌকার ভিতরে। সে খুব মজায় আছে। স্যার একটা কাজ করবেন?
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, বল কী কাজ?
ফতে বলল, আপনি আমার সঙ্গে চলেন। নৌকা থেকে দুজনে মেয়েটাকে নিয়ে আসি।
মিসির আলি বললেন, চল যাই।
ফতে বলল, দুজন একসঙ্গে বের হলে মামি সন্দেহ করবে। স্যার আপনি আগে চলে যান। সদরঘাট লঞ্চ টাৰ্মিনালের সামনে চায়ের দোকান আছে। ঐখানে বসে চা খান–আমি মামিকে বলি লুনাকে খোজার জন্যে বের হচ্ছি। এই বলে চলে আসব। আমার পৌঁছতে দশ মিনিটের বেশি দেরি হবে না। স্যার যাবেন?
মিসির আলি বললেন, হ্যাঁ।
এক ঘণ্টার বেশি হয়েছে মিসির আলি অপেক্ষা করছেন। ফতের কোনো দেখা নেই। তিনি দুশ্চিন্তা করা শুরু করেছেন। ফতে লুনা সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে মিসির আলির কাছে মনে হয়েছে এই ব্যাখ্যা ঠিক না। ফতে তাৎক্ষণিকভাবে একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়েছে। মানসিকভাবে অসুস্থ একটা মেয়েকে রাতের বেলা বুড়িগঙ্গায় নৌকার উপর রাখার কোনো যুক্তি নেই। মেয়েটিকে লুকিয়ে রাখলে তার বাবা তাকে খুব কাছাকাছি কোথাও রাখবে। বুড়িগঙ্গায় নৌকার উপর পাঠাবে না। মিসির আলির মনে হল লুনা মেয়েটি বিপদে আছে। সহজ কোনো বিপদ না। জটিল ধরনের বিপদ। বিপদ ঘটতে খুব দেরিও নেই। মিসির আলি ইয়াসিনের দিকে তাকালেন। ইয়াসিন কী মনে করে যেন তাঁর সঙ্গে এসেছে। ইয়াসিনকে কি লুনার বাবার কাছে চিঠি দিয়ে পাঠাবেন? তিনি অপেক্ষা করবেন। ফতের জন্যে-ইয়াসিন চিঠি নিয়ে চলে যাবে বদরুল সাহেবের কাছে। চিঠিতে লেখা থাকবে–আপনার মেয়ের মহাবিপদ। পুলিশে খবর দিন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কী তার মাথায় আসছে না। মাথায় এলে সেটাও চিঠিতে লিখে দিতেন।
মিসির আলি চমকে দেখলেন ফতে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
জামে আটকা পোড়ে গেছিলাম—এমন জাম শেষে বেবিট্যাক্সি রেখে হেঁটে চলে এসেছি। স্যার চলেন যাই–।
মিসির আলি কিছু বললেন না, নিঃশব্দে ফতেকে অনুসরণ করলেন। ফতে বলল, সঙ্গে সিগারেট আছে স্যার? না থাকলে নিয়ে নেই। নদীর মাঝখানে সিগারেট টান দিতে বড়ই মজা।
সিগারেট সঙ্গে আছে?
মিসির আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, সিগারেট সঙ্গে আছে।
ইঞ্জিন লাগানো নৌকা। বেশ বড়সড়। অনেকটা বজরার মতো দরজা-জানালা আছে। নৌকায় কোনো মাঝি নেই। ফতে নিজেই ইঞ্জিন চালু করে নৌক ছেড়ে দিয়ে বললস্যার আপনি ভিতরে যান। লুনা ভেতরে আছে। এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল—এখন মনে হয় জেগেছে।
মিসির আলি বললেন, মেয়েটা একা ছিল নাকি?
ফতে বলল, একই ছিল। তার কাছে একা যে কথা দোকা তিকাও সেই কথা। যান স্যার মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেন-এর মধ্যে আমি নৌকা ঐ পারে নিয়ে যাই।
নৌকা ঐ পারে নেবার দরকার কী?
দরকার আছে স্যার। ফতে বিনা প্রয়োজনে কোনো কাজ করে না। ঐ পারে ভিড় নাই।
মিসির আলি দরজা খুলে নৌকার ভেতরে ঢুকলেন। লুনা বসে আছে। তার সামনে লজেন্সের দুটা প্যাকেট। সে প্যাকেট থেকে সব লিজেন্সের খোসা ছাড়িয়ে এক পাশে রাখছে। কাজটায় সে খুবই আনন্দ পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। মিসির আলির দিকে তাকিয়ে লুনা হাসল। একটা লজেন্স মিসির আলির দিকে বাড়িয়ে দিল।
মিসির আলি বললেন, খুকি। তুমি কেমন আছ?
লুনা বলল, ভালো।
কী কর?
খেলি।
এই খেলার নাম কী?